রক্তচাপ কি, কত প্রকার ও কি কি - আদর্শ রক্তচাপ বলতে কি বুঝায়

রক্তচাপ পরিমাপ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের সকলের নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করা প্রয়োজন। মানব শরীরে স্বাভাবিক নিয়মেই রক্তচাপের পরিবর্তন হয়ে থাকে। রক্তচাপ দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হতে পারে।
রক্তচাপ কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি - আদর্শ রক্তচাপ বলতে কি বুঝায়
যেমন- ঘুমের সময় বা শোয়া অবস্থায় রক্তচাপ কম থাকে।ঘুম ভাঙার কয়েক ঘণ্টা আগে রক্তচাপ কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে, বিকালে রক্তচাপ সর্বোচ্চ হয়। আবার রাতে ঘুমের সময় রক্তচাপ হ্রাস পায়। শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ার সাথে সাথে রক্তচাপও বাড়তে থাকে। খাদ্য পরিপাক, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের সময় রক্তচাপ বেশি হয়।

ভুমিকা

রক্তচাপ মানব দেহের অতিগুরুত্বপুর্ণ একটি সূচক। মানুষের ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্তের প্রবাহকে রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার বলে। প্রতিটি মানুষের রক্তচাপ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে উচ্চরক্তচাপের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এক্ষেত্রে লাইফ স্টাইল, খাদ্যাভ্যাস এবং শহর জীবনের মানসিক চাপ বড় ভূমিকা রাখছে। উচ্চরক্তচাপের অপর নাস হলো ‘নীরব ঘাতক’। কারণ অনেক সময় উচ্চরক্তচাপের খুব বেশি লক্ষণ না দেখা যায় না ফলে ব্যক্তির প্রানহানিও ঘটতে পারে।

রক্তচাপ কাকে বলে (Blood Pressure)

রক্ত মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রক্তচাপ কাকে বলে এটা জানার আগে আমাদের জানতে হবে রক্ত কি ভাবে মানবদেহে সঞ্চারিত হয়। হৃদপিণ্ডের সঙ্কোচন ও প্রসারণের দ্বারা রক্তনালীর মধ্য দিয়ে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। মানবদেহে রক্ত সঞ্চলনের সময় রক্ত ধমনী বা রক্তনালীর গায়ের উপর যে চাপ প্রয়োগ করে তাকে রক্তচাপ বলে।
সাধারণত, রক্তচাপ বলতে ধমনী বা বড় রক্তনালীতে রক্ত সঞ্চলন প্রনালীর চাপকে নির্দেশ করে বা সিস্টেমিক প্রবাহ-এর ধমনীক প্রবাহ (Arterial Pressure) কে বোঝানো হয়। রক্তচাপের প্রধান কারণ হলো হৃদপিন্ডের সংকোচন প্রবণতা। রক্তচাপ (Blood Pressure) সাধারণত উর্ধ্ববাহুর ব্রাকিয়াল ধমনীতে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

রক্তচাপ নির্ণয়ের যন্ত্র ও একক

রক্তচাপ নির্ণয়ের যন্ত্রের নাম স্ফিগমোম্যানোমিটার।
রক্তচাপ নির্ণয়ের এককঃ mmHg বা মিলিমিটার পারদ চাপ।

রক্তচাপ কত প্রকার

রক্তচাপ দুই প্রকার৷ যথাঃ
(১) সিস্টোলিক রক্তচাপ (হৃদপিন্ডের সংকোচন) এবং
(২) ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ (হৃদপিন্ডের প্রসারণ)

সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কাকে বলে

সিস্টোলিকঃ
হৃপিণ্ডের সংকোচন (Systol অবস্থায় ধমনীর গায়ে রক্তচাপের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। হৃৎপিণ্ডের সংকোচনের ফলে রক্ত ধমনীর গায়ে যে চাপ প্রয়োগ করে তাকে সিস্টোলিক চাপ (Systolic Pressure) বলে।
ডায়াস্টোলিকঃ
হৃদপিণ্ডের প্রসারণ (Diastol) অবস্থায় ধমনীর গায়ে রক্তচাপের মাত্রা সবচেয়ে কম থাকে। হৃৎপিণ্ডের প্রসারণের ফলে রক্ত ধমনীর গায়ে যে চাপ প্রয়োগ করে তাকে ডায়াস্টোলিক চাপ (Diastolic Pressure) বলে।

আদর্শ রক্তচাপ কি

রক্তচাপকে দুটি মানদন্ডে পরিমাপ করা হয়। প্রথমটি উচ্চমান এবং দ্বিতীয়টি নিম্নমান।
উচ্চমানঃ রক্তের সিস্টোলিক (Systolic) চাপ বা সংকোচক এর আদর্শ মান ১২০ মিলিমিটার পারদ চাপ এর নিচে।
নিম্নমানঃরক্তের ডায়াস্টোলিক (Diastolic ) চাপ বা প্রসারকএর আদর্শ মান ৮০ মিলিমিটার পারদ চাপ এর নিচে।
চিকিৎসকদের মতে, সাধারণত একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের আদর্শ রক্তচাপ (Blood Pressure) প্রায় ১২০ মিলিমিটার পারদচাপ সংকোচক এবং ৮০ মিলিমিটার পারদচাপ প্রসারক। সংক্ষেপে- ১২০/৮০ মিমি পারদ।
[হৃদপিণ্ডের সিস্টোলিক রক্তচাপ কে উপরে এব ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কে নিচে লেখা হয়।]
ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ হৃদপিণ্ডের দুটি বিটের মাঝামাঝি সময় রক্তনালীতে সৃষ্টি হয়। এই দুই ধরণের রক্তচাপের পার্থক্যকে ধমনীঘাত বা নাড়ি স্পন্দন (Pulse Pressure) বলে। সাধারণত সুস্থ অবস্থায় হাতের কব্জিতে হৃদস্পন্দনের মান প্রতি মিনিটে ৬০-১০০ বার। হাতের কব্জিতে হালকা চাপ দিয়ে ধরে Pulse Rate বের করা যায়।

রক্তচাপ কেন মাপবেন

কথায় আছে, উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) একটি নীরব ঘাতক। কিন্তু কোন ঘাতক বা বিপদ বলে কয়ে আসে না। তাই প্রত্যেকটা মানুষের রক্তচাপ সম্পর্কে সচেতন থাকা অপরিহার্য। এই নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করার বিকল্প নেই। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা নিয়মিত রক্তচাপ মাপার জন্য ম্যানুয়াল যন্ত্র বা ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করতে পারেন।
রক্তচাপের সঠিক পরিমাপের জন্য অবশ্যই যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ জানা থাকতে হবে। তবে রক্তচাপ মাপার ক্ষেত্রে ম্যানুয়াল যন্ত্র বা ডিজিটাল যন্ত্র কোন যন্ত্রের উপর আস্থা রাখা উচিত? এই প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই। রক্তচাপ নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে আবিষ্কৃত ডিজিটাল যন্ত্র এখনো চিকিৎসকদের পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তবে চিকিৎসকেরা বলে থাকেন,- যদি কেউ ম্যানুয়াল যন্ত্র দ্বারা রক্তচাপ মাপতে না পারেন সে ক্ষেত্রে তিনি ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করে রক্তচাপ নির্ণয় করতে পারেন।
কিন্তু কত বার মাপবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসকরা বলেন যে অনেক সময় একই রোগীর কয়েকবার রক্তচাপ মাপার প্রয়োজন হয়্। প্রথমে একজন রোগীর রক্তচাপ বেশি পাওয়া গেলে তাঁকে পাঁচ–ছয় মিনিট পর আবার মেপে দেখা হয় মাপটি ঠিক রয়েছে কি না। বিশেষ কিছু রোগের ক্ষেত্রে কয়েকবার মাপার প্রয়োজন হয়। যেমন: ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে একবার বসিয়েে এবং একবার দাঁড় করিয়ে মাপপ হয়।

রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র বাড়িতে রাখার সুবিধা

নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপের জন্য বাড়িতে অবশ্যই রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র রাখুন।
  • বাড়িতে রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র থাকলে আপনি সহজেই নিজের বা পরিবারের অন্য সদস্যের রক্তচাপ মেপে হিসাব রাখতে পারেন।
  • প্রতিদিন রক্তচাপ নির্ণয় আপনাকে নির্ভরযোগ্য এবং সুনির্দিষ্ট ফলো-আপ এ রাখতে সাহায্য করবে।
  • ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে, শারীরিক ব্যায়াম করার সময় অথবা আপনি নতুন কোন ডায়েটে নিজেকে অভ্যস্ত করতে চাচ্ছেন সে ক্ষেত্রে আপনার রক্তচাপের ইতিবাচক, নেতিবাচক বা শূন্য প্রভাবগুলো পরিমাপ ও মূল্যায়ন করতে পারেন।
  • কোন গুরুতর মুহর্তে রক্তচাপ নির্ণয় করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেন।

রক্তচাপ পরিমাপের জন্য যে বিষয়গুলি মাথায় রাখবেন

রক্তচাপ কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি - আদর্শ রক্তচাপ বলতে কি বুঝায়
  • রক্তচাপ পরিমাপের অন্তত এক ঘণ্টা আগে কোনো শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম বা খেলাধুলা করবেন না।যা রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্রকে প্রভাবিত করতে পারে।
  • রক্তচাপ পরিমাপের পূর্বে অন্তত ১০ মিনিট আরাম করুন এবং প্রসাব করে নিন।
  • রক্তচাপ পরিমাপের পূর্বে খাবার, ধূমপান, অ্যালকোহল, চা বা কফি পান করা থেকে বিরত থাকুন। পরিমাপের সময় বারবার কথা বলা বা যন্ত্র স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
  • টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে পিছনে হেলান দিয়ে বসুন।
  • দুই হাত হৃদযন্ত্রের সমতল করো টেবিলের উপর রাখুন।
  • রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্রের কাফটি কনুই থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার উপরে বাঁধুন।
  • যন্ত্রের কাফটি জামা বা কাপড়ের উপর বাঁধবেন না । ত্বকের উপর বাঁধুন।
  • কাফটি খুব শক্ত করে বাঁধবেন না।
  • এরপর কনুইয়ের উপর হাত দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীর অবস্থান নির্ণয় করে স্টেথোস্কোপের ডায়াফ্রাম বসান। ডায়াফ্রাম কাপড়ের উপর রাখবেন না। খেয়াল রাখুন মিটারের স্কেলটি যেন হৃদযন্ত্রের সমতলে থাকে।

শেষকথা

পরিশেষে বলা যায়, রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে হলে খাদ্যাভ্যাস এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন আবশ্যক। ধূমপান, অ্যালকোহল, ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড, চর্বি যুক্ত খাবার, অতিরিক্ত তেল খাওয়া ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় তাজা ফলমূল, শাক-সবজি, দানাদার শস্য, বাদাম, ডাল ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ব্যায়াম করা জরুরি। ব্যায়াম রক্তনালির দৃঢ়ভাব কমিয়ে রক্তচাপ কম রাখতে সহায়তা করে।

উচ্চরক্তচাপ হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি, চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। আবার নিম্ন-রক্তচাপও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। নিম্ন-রক্তচাপ হলে ঝিমঝিম ভাব, মাথাঘোরা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। সর্বপরি সকল মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url