গর্ভবতী মায়ের করণীয় ও পরিচর্যা-মায়ের দুধের উপকারিতা

গর্ভবতী মায়ের উপযুক্ত সময়ে নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত স্বাস্থ পরীক্ষা করা এবং গর্ভাবস্থায় শারীরিক ও মানষিক ভাবে সুস্থ থাকা ও স্বাভাবিক ভাকে সন্তান জন্মদান সম্পর্কে উপদেশ ও নির্দেশনা দেওয়াকে গর্ভাবস্থায় পরিচর্যা বলে।
গর্ভবতী মায়ের করণীয় ও পরিচর্যা-মায়ের দুধের উপকারিতা
নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য এটি একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশে গর্ভজনিত কারণে মায়ের মৃত্যুহার উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দু-তিন'শ গুণ বেশি।

সূচিপত্রঃ- গর্ভবতী মায়ের করণীয় ও পরিচর্যা-মায়ের দুধের উপকারিতা

গর্ভবতী মায়ের করণীয়

(১) গর্ভাবস্থায় খাবার তালিকাঃ গর্ভবতী মায়ের পুষ্টির উপরই নির্ভর করে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ জীবনে ভালো থাকা। তাই সুষম সহজপাচ্য ও সঠিক পরিমাণ আহার প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় সুষম আহার বলতে বোঝায় বেশী পরিমাণ প্রোটিন, সঠিক পরিমাণ শর্করা ও কম পরিমাণ চর্বি জাতীয় খাদ্যের সংগে উপযুক্ত পরিমাণ লৌহ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও অন্যান্য, পদার্থ, যথা- জিঙ্ক, ফলিক এসিড, পটাসিয়াম, সেলেনিয়াম প্রভৃতি। মায়ের খাদ্য থেকে যে পরিমাণ লৌহ আসে তাতে গর্ভকালীন লৌহের প্রয়োজন মেটে না, তাই প্রতিদিন ২০০ মিলিগ্রাম ফেরাস সালফেট বড়ি সেবন করতে হয়। একজন ৫০ কেজি ওজনের গর্ভবতী নারীর দৈনিক ২৫০০ ক্যালরি দরকার।
সম্ভব হলে দিনে ১ লিটার দুধ, ১ বা ২ টুকরা মাছ বা মাংস, ১টি ডিম, ১টি বা ২টি ঋতুকালীন ফল, টাটকা শাকসব্জি এবং ভাত ও ডাল পেট ভরে খাওয়া উচিত। নিরামিষভোজীদের দুধের পরিমাণ বাড়াতে হয়। তা ছাড়া অঙ্কুরিত ছোলাও খাদ্য তালিকায় যোগ করা উচিত। প্রতিদিন ৬-৮ গ্লাশ ফোটানো পানি খাওয়া প্রয়োজন। পাতে বাড়তি লবণ, ঝাল-মশলাদার খাবার, ভাজা, চাটনি ইত্যাদি খাওয়া গর্ভাবস্থায় এড়িয়ে চলা উচিৎ। রাস্তাঘাটের অপরিস্কার খাবার, টক-ঝাল খাবার, ভাজা পোড়া খাবার, ফস্ট ফুড পরিহার করুন।
(২) অস্ত্রঃ গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা থাকে। এর সমাধানকল্পে বেশি পরিমাণ শাকসজি খাওয়া দরকার। তা ছাড়া শুকনো খেজুর ও বীট খাবার তালিকায় রাখা উচিত। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জোলাপ খাওয়া যেতে পারে।
(৩) দাঁতঃ গর্ভাবস্থায় দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। তাই এ সময় দাঁত তুলতে গেলে বিপদ হতে পারে। এসব ব্যাপার পরিহার করতে হবে।
(৪) স্তনঃ স্তনবৃন্ত স্তনের মধ্যে ঢুকে থাকলে তা উপরে উঠানোর চেষ্টা করতে হবে যাতে প্রসবের পর শিশুকে স্তন্যদানে কোনো সমস্যা না হয়। এ জন্য কোনো ক্রিম ব্যবহার করা উচিত। তা না হলে দুধ জমে গিয়ে স্তনেও নানা কষ্টের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
(৫) বিশ্রাম ও নিদ্রাঃ গর্ভাবস্থায় পরিমিত বিশ্রাম দরকার। দুপুরে দু'ঘন্টা, রাতে আট ঘন্টা বিশ্রাম নেয়া উচিত। সব সময় বাঁ পাশে কাত হয়ে শোয়া উচিত। এতে শিশুর বিকাশ স্বাভাবিক হয়। গর্ভাবস্থায় মায়েরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন, কিন্তু ভারী কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
(৬) ত্বকঃ গর্ভাবস্থায় তলপেটের চামড়ায় টান পড়ার জন্য যোজক কলার তন্তুগুলো ছিঁড়ে যায়, ফলে তলপেটে সাদা দাগ পড়ে। এ অবস্থা এড়াতে হলে গর্ভাবস্থায় প্রথম মাস থেকে প্রসবের পরেও কয়েক মাস বুকে ও পেটে রোজ তেল মালিশ করতে হবে। কখনো সে জায়গা নখ দিয়ে আঁচড়ানো উচিত নয়।
(৭) গোসলঃ রোজ গোসল করে শরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গোসল করার সময় যেন পিছলে পড়ে না যায় সেদিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। গর্ভজনিত কারণে গর্ভের শেষ মাসগুলোতে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
(৮) পোষাক-পরিচ্ছদঃ গর্ভাবস্থায় ঢিলেঢালা কাপড় পড়া উচিত। বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে আবহাওয়ার সংগে খাপ খাইয়ে সুতীর কাপড়-চোপড় পড়া স্বাস্থ্যসম্মত। তাই সিম্পেটিক বা নাইলনের অন্তর্বাস ব্যবহার না করাই ভালো। খুব সাঁটোসাটো পোশাক ও উঁচু হিলের জুতা পরিহার করা দরকার।
(৯) ভ্রমণঃ ঝাঁকুনিযুক্ত ক্লান্তিকর ভ্রমণ গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস ও শেষ দুমাস না করাই ভালো। বাসের চেয়ে রেল ও বিমানে ভ্রমণ-ঝুঁকি অনেক কম।
(১০) ধূমপান ও মদ্যপানঃ গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপান অনুচিত। তা না হলে কম ওজনের শিশু কিংবা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
(১১) ড্রাগ (ওষুধ বা মাদকদ্রব্য): গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে প্রথম তিন মাস অত্যন্ত সতর্কতার সংগে এবং নিরাপদ সুনিশ্চিত জেনে তবেই ওষুধ সেবন করা উচিত। কারণ অনেক ওষুধ গর্ভস্থ শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।
(১২) যৌন সহবাসঃ গর্ভের প্রথম তিন মাস ও শেষ দেড় মাস যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা উচিত। এতে গর্ভপাত, অকাল প্রসব ও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
(১৩) টীকাঃ গর্ভাবস্থার পঞ্চম ও ষষ্ঠ মাসে টিটেনাস টক্সাইডের একটি করে মাত্রা নেয়া উচিত। এতে শুধু মা- ই নয় নবজাত শিশু দেড় মাস বয়স পর্যন্ত ভয়ংকর ধনুষ্টংকার (টিটেনাস) রোগ থেকে রক্ষা পায়।

গর্ভাবস্থায় পরিচর্যার উদ্দেশ্য

১) জটিল গর্ভ বা ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভের কারণে মা ও শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা।
২) নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি করা।
৩) গর্ভের জন্য কিছু রোগ বা জটিল সমস্যা নির্ণয়, প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা।
৪) নিজের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখার জন্য মানসিক অবস্থার উন্নতি করা।
৫) গর্ভবতী নারীকে খাদ্য-পুষ্টি, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি ও শিশুর যত্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করা।

প্রসূতি মায়ের পরিচর্যা

প্রসূতি মায়ের পরিচর্যা গর্ভবতী মায়ের মতো প্রসূতি মায়েরও পরিচর্যার প্রয়োজন রয়েছে। নিচে সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হচ্ছে।
১। প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে হবে এবং মন প্রফুল্ল রাখতে হবে।
২। তাকে কোন ভারী কাজ দেয়া যাবে না।
৩। প্রচুর শাকসব্জি, ফলমূল খাওয়াতে হবে যাতে মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়।
৪। মাকে বিশ্রাম নিতে হবে এবং আলো ও মুক্ত বায়ুসমৃদ্ধ স্থানে রাখতে হবে।
৫। পরিষ্কার জামা কাপড় পরিধান করতে হবে।
৬। স্তনবৃন্ত সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
৭। শিশু ঠিকমত মায়ের দুধ পাচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে। না পেলে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
৮। অনেক সময় বুকে দুধ থাকলেও শিশু তা গ্রহণ করতে পারে না ফলে মায়ের স্তনে ব্যথা হয়। এ অবস্থায় মাকে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।

চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ

গর্ভবতী হওয়ার প্রাথমিক সময় থেকেই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন কিনা নিশ্চিত হওয়ার পর ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার, পরবর্তী ২৯-৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি মাসে দুই বার এবং ৩৭ সপ্তাহ থেকে সন্তান প্রসবের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একবার শারীরিক পরীক্ষা করানো উচিত। এরপরেও হঠাৎ কোন সমস্যা দেখা দিলে নির্ধারিত দিনের পূর্বেই নিকটবর্তী ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্রথম পরীক্ষার সময় রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করিয়ে নিতে হয়, (তবে ডাক্তার ভালো জানেন কি কি পরীক্ষা করানো প্রয়োজন)।

রক্তের গ্রুপ, যৌনরোগ (V.D.R.L), রক্ত শর্করা ও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয় তাতে আমিষ বা শর্করা আছে কিনা তা জানার জন্য। পরবর্তী পরীক্ষায় ভূণের বৃদ্ধি, মায়ের ওজন বৃদ্ধি (যা ১২-২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত লাগাতার হয়), রক্তচাপ, গা-হাত-পা ফুলে উঠা, ভূণের অবস্থান প্রভৃতি নানা বিষয়ের পরীক্ষা করা হয় এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। গর্ভাবস্থায় ছোট-খাট সমস্যাগুলো হচ্ছে বমিভাব বা বমিকরা, কোমর ব্যথা, পা ব্যথা বা পায়ে খিল ধরা, বুক জ্বলা, অর্শের সমস্যা ও সাদা স্রাব। এসব কষ্ট লাঘবের জন্য উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়।

জন্মের পরে মাতৃদুগ্ধ পান

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নিকটতমজন হলো তার মা। অসহায় নবজাত শিশুর পক্ষে শক্ত খাবার চিবানো ও হজম করার ক্ষমতা থাকে না বলে প্রকৃতিও তাই সে সময় মায়ের বুকে অনন্য সাধারণ আদর্শ তরল খাদ্য-দুধের সৃষ্টি করে। মাতৃগর্ভে ভূণ সঞ্চারিত হলে স্তন দুধ উৎপন্ন করার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত মায়ের বুকে দুধ আসে না। তন প্রচুর মেদকোষ ও গ্রন্থিকোষ দিয়ে তৈরি। গর্ভস্থ মায়ের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরণ হরমোন ক্ষরণের ফলে স্তনের দুগ্ধক্ষরা কোষ ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

এরকম অনেকগুলো কোষ মিলে তৈরি করে লবিউল। লবিউলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নালিকা মিলে তৈরি হয় বড় নালিকা। বড় নালিকাগুলো এসে স্তনবৃন্তে মিলিত হয়। তনের লবিউল কোষে দুধ উৎপন্ন হয়। পিট্যুইটারি, হাইপোথ্যালামাস ও থাইরয়েড গ্রন্থির সমন্বিত কার্যক্রম পুরো ব্যাপারটি তদারক করে। মায়ের বুকে দুধ উৎপাদনের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো- (১) হরমোনের নিঃসরণ ঠিকমতো হওয়া; (২) স্তনের গঠন ঠিক থাকা; (৩) মন প্রফুল্ল রাখা; এবং (৪) নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।

মায়ের দুধের উপকারিতা

দুধ হচ্ছে শিশুর আদর্শ বা পূর্ণ খাদ্য। এর কোনো বিকল্প নেই। নিচে মাতৃদুগ্ধের গুণাবলী বা মাতৃদুগ্ধ পানের সুফল উল্লেখ করা হলোঃ
(১) সমস্ত পুষ্টিগুণঃ মাতৃদুগ্ধে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান থাকে। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ এ পাঁচটি উপাদানই দুধে পাওয়া যায়।
(২) সহজপাচ্যতাঃ মায়ের দুধে বেশী পরিমাণে যে প্রোটিনগুলো থাকে (ল্যাকটালবুমিন ও ল্যাকটোগ্লোবিউলিন) তা সহজেই শিশু হজম করতে পারে। এ ছাড়া 'ক্যাসিন' ছোট ছোট দানায় পরিণত হওয়ায় হজমে কোনো অসুবিধা হয় না। দুধে প্রোটিনের পরিমাণ কম হওয়ায় বৃক্কের উপর চাপ কম পড়ে। মায়ের দুধে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশী হওয়ায় সে ফ্যাট সহজেই হজম হয়ে যায়। প্রোটিন ও ফ্যাট সহজে হজম হয় বলে শিশুর তাড়াতাড়ি ক্ষিদে পায়।
গর্ভবতী মায়ের করণীয় ও পরিচর্যা-মায়ের দুধের উপকারিতা
(৩) সংক্রমণের সম্ভাবনা মুক্তঃ এ দুধ সরাসরি মায়ের বুক থেকে শিশুর মুখে যায় বলে এ দুধ জীবাণু সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকে।
(৪) সহজলভ্যতাঃ শিশু চাইলে সংগে সংগেই এ দুধ পেতে পারে। শিশু প্রয়োজন মাফিক তা গ্রহণ করে।
(৫) ব্যয় স্বল্পতাঃ যে কোনো খাবারই কিনে খেতে হয়, কিন্তু মায়ের দুধের বেলায় তা ব্যতিক্রম। তিন মাস বয়সী শিশু প্রায় ৬০০-৭০০ মিলিলিটার দুধ পান করে। শিশু মায়ের দুধ না খেলে অন্য দুধ কিনে খাওয়াতে হবে যা বর্তমান বাজারে অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ। মায়ের দুধ পানকারী শিশুর জন্য দুধ কেনার প্রয়োজন হয় না। তবে মাকে একটু বেশি খাবার খেতে হয় (প্রতিদিনের খাবারের সংগে দুটি ত্রুটি, মাঝারি এক বাটি ভাত ও ডাল খেলেই যথেষ্ট)। এর ফলে যে টাকা সাশ্রয় হবে তা দিয়ে সংসারের এবং শিশুর অন্যান্য প্রয়োজনে খরচ করা যাবে।
(৬) দৈহিক ও মানসিক বিকাশঃ মায়ের দুধ শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খুব সহায়ক। প্রকৃতিতে যত খাদ্য আছে তাতে শর্করা হিসেবে ল্যাকটোজ আছে একমাত্র দুধে। ল্যাকটোজ শরীরে গিয়ে গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজে ভেঙে যায়। গ্যালাকটোজ মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য একান্ত প্রয়োজন। দুধে ল্যাকটোজ না থাকলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সম্ভব হতো না। মস্তিষ্কের বিকাশ যা ঘটার তা শিশুর জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে হয়ে যায়। অন্য জীবের তুলনায় মাতৃদুখেই ল্যাকটোজ সবচেয়ে বেশি। তাই পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুর দুধ খাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
(৭) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাঃ মায়ের দুধে রোগ প্রতিরোধকারী পদার্থ থাকে যা শিশুকে বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা করে। দুধের এসব রোগ প্রতিরোধকারী পদার্থের মধ্যে রয়েছে ইম্যুনোগ্লোবিউললিন (IgA, IgG, IgM প্রভৃতি), বিভিন্ন কোষীয় উপাদান (লিম্ফয়েড কোষ, শ্বেতকণিকা, ম্যাক্রোফেজ প্রভৃতি), ল্যাকটোফেরিন, ট্রান্সফেরিন, ল্যাকটোপার অক্সিডেজ, লাইসোজাইম, T-লিম্ফোসাইট, বর্ধক উপাদান এবং ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া বিরোধী উপাদান।

ফলে শিশু সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া জাতীয় অসুখে কম ভোগে এবং পোলিও হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এনকেফালাইটিস, জিয়ার্ডিয়াসিস ইত্যাদির বিরুদ্ধে শিশুর শরীরে প্রতিরোধ গড়ে উঠে। শিশুর জন্মের প্রথম পাঁচদিন দুধ হয় না। সে সময় এক ধরনের ঘন হলুদ জাতীয় পদার্থ বের হয়। একে প্রি-মিল্ক বা কলোস্ট্রাম বা শালদুধ বলে। এতে থাকে 'রোগ প্রতিরোধক নানান উপাদান। এ পাঁচ দিন কলোস্ট্রাম খেলে বাচ্চাকে আর কিছুই খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। চারমাস বয়স পর্যন্ত শিশুর মাতৃদুগ্ধ ছাড়া আর কিছুই প্রয়োজন পড়ে না।
(৮) খিঁচনি ও অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষাঃ মায়ের দুধ শিশুকে স্থূলতা বা মুটিয়ে যাওয়া, খিঁচুনি রোগ (Tetany), পানিশূন্যতা, একজিমা প্রভৃতি রোগ থেকে রক্ষা করে।
(৯) দাঁতের মাড়ি শক্তকরণঃ স্তন চুষে দুধ খাওয়ার ফলে শিশুর মাড়ি শক্ত হয় এবং দাঁতের বর্ধন ভালো হয়।
(১০) মা ও শিশুর আত্মিক সংযোগঃ মায়ের দুধ খেলে মা ও শিশুর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো হয় যা শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খুব সাহায্য করে। ফলে প্রত্যেক শিশুরই মায়ের প্রতি এক আলাদা আকর্ষণ জন্মায়।

স্তন্যদানের মাধ্যমে মায়ের উপকার

মায়ের দুধ কখনোই একমুখী কল্যাণকর নয়। এতে মা ও শিশু উভয়ে উপকৃত হয়। নিচে স্তন্যদানের মাধ্যমে মায়ের উপকারের কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলোঃ
(১) শরীরের ওজন হ্রাসঃ বেশি পরিমাণ চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে অনেক মা প্রসবের আগে বা পরে শরীরের ওজন অত্যধিক বাড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে বেশী পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন পড়ে তা ওজন কমাতে সাহায্য করে। এ ওজন বাড়ে না কারণ শরীরে দুধ তৈরি হতে যে
(২) স্তনব্যথার উপশমঃ বাচ্চাকে দুধ না খাওয়ালে দুধ জমে মায়ের স্তন শক্ত হয়ে ব্যথা হয় এবং নানা রকম কষ্ট দেখা দেয়। শিশু দুধ খেলে এসব উপসর্গ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
(৩) স্তন-ক্যান্সারের সম্ভাবনা হ্রাসঃ শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন-ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
(৪) জরায়ুর পূর্বাবস্থায় ফিরে আসাঃ শিশু স্তনবৃন্ত থেকে সরাসরি পান করলে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এ হরমোনের প্রভাবে জরায়ু আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
(৫) স্তনের গড়ন ঠিক রাখাঃ শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে এক ধরনের পরোক্ষ ব্যায়াম হয় বলে স্তনের আকার ঠিক থাকে। বাচ্চা যখন স্তনবৃন্তে দুধ পান করে তখন সেখানে রক্ত সংবহন মাত্রা অনেক বেড়ে যায় এবং স্তনগ্রন্থিতে এক ধরনের সঞ্চালন ঘটে। ফলে স্তনগ্রন্থিকে ধরে রাখা লিগামেন্টগুলো আরও শক্ত হয় এবং স্তনের গড়ন দৃঢ় হয়।
(৬) জন্মনিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালনঃ দীর্ঘদিন শিশু মায়ের দুধ খেলে মায়ের গর্ভসঞ্চার সম্ভাবনা কম থাকে, ফলে দুটি সন্তানের মধ্যে জন্মের ব্যবধান বৃদ্ধি করে। স্তন্যপান করালে প্রোল্যাকটিন হরমোন বেশি মাত্রায় ক্ষরিত হয় বলে পিটুইটারি গ্রন্থির ল্যুটিনাইজিং হরমোন (LH) বাধাপ্রাপ্ত হয়। ডিম্বাশয়ে সামান্য পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমোন তৈরি হলেও প্রোজেস্টেরণ হরমোন তৈরি হতে পারে না। ফলে ডিম্বপাত ও ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে (lactational amenorrhoea)। এভাবে ডিম্বপাত না হওয়ায় গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনাও থাকে না।
তথ্যসুত্রঃ (পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক) সহায়িকা
বিঃ দ্রঃ- এই পোষ্টের সকল তথ্য শুধুমাত্র গর্ভবতী মায়ের করণীয় ও পরিচর্যা সম্পর্কে জানা উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে কোন প্রকার চিকিৎসা মূলক কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। প্রয়োজনে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url