মরুময়তার কারণ-মরুকরণ রোধের উপায়
অনন্য বৈশিষ্ট্য ও সম্পদে ভরপুর ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র।
মরুভূমি, আধাশুষ্ক ভূমি, পর্বত, জলাভূমি, ছোট ছোট দ্বীপ ও কয়েকটি উপকূলীয় এলাকা
ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। ভূ-পৃষ্ঠের ১৪.৯ বিলিয়ন হেক্টর হচ্ছে
স্থলভাগ।
UNEP (United Nations Environmental Programme) এর এক জরিপে দেখা গেছে যে এর
মধ্যে ৬.১ বিলিয়ন হেক্টর হলো শুকনো জমি। শুকনো জমির মধ্যে ১ বিলিয়ন হেক্টর
প্রাকৃতিকভাবে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বাকি অংশে চলছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। এর ফলে
পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মানুষ হবে ক্ষতিগ্রস্ত। এর সংগে সংগে বাড়বে দুর্ভিক্ষ ও
দারিদ্র, নষ্ট হবে গোচারণভূমি ও জমির উর্বরতা। তা ছাড়া, ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর
শুকনো ভূমির কৃষিজমিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সূচিপত্রঃ- মরুময়তার কারণ-মরুকরণ রোধের উপায়
মরুকরণ ও মরুময়তা কি
মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াই মরুকরণ। এটি আবহাওয়া পরিবর্তন সম্পর্কিত
প্রাকৃতিক পদ্ধতি বা ভূমির অপব্যবহারের ফলে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে আবহাওয়া
পরিবর্তনের বিষয়টিও প্রধানত ভূমির অপব্যবহারের ফলেই হয়ে থাকে। গাছপালা বিনাশের
ফলে কোনো অঞ্চলের স্থানীয় আবহাওয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এভাবে, বন ধ্বংস,
অতিচারণ ইত্যাদির জন্য বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, পানিস্তর, বাতাসের বেগ প্রভৃতির
পরিবর্তন ঘটে এবং ভূমিক্ষয় হয়। এসব পরিবর্তনই কোনো অঞ্চলকে মরুকরণের দিকে নিয়ে
যায়। United Nations Convention to Combat Desertifiication প্রদত্ত ও
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী, আবহাওয়াগত বৈষম্য ও মানুষের কর্মকান্ডের
ফলে শুষ্ক, আধা শুষ্ক ও শুষ্ক উপআর্দ্র অঞ্চলে ভূমির অবক্ষয়কে মরুময়তা বলে।
মরুময়তার কারণ
মরুময়তার প্রধান কারণ দুটি, যথা-(১) আবহাওয়ায় তারতম্য, ফলে শুষ্ক অঞ্চলে নিয়মিত খরা দেখা দেয়।
(২) মানব কর্মকাণ্ড, যথা-
ক) আধাশুষ্ক অঞ্চলে শিকার ও কাঠ আহরণের জন্য জীব বৈচিত্র্যের পরিমাণ হ্রাস।
খ) ভৌত বা রাসায়নিক কারণে ভূমির অবক্ষয়।
গ) অবাধ বৃক্ষনিধন ও বনভূমি হ্রাসের ফলে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির পরিমাণ হ্রাস।
ঘ) পানিচক্রের পরিবর্তনের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার।
ঙ) আর্থিক অবকাঠামোর দুর্বলতা ও মানবেতর জীবন যাপন।
চ) শুকনো ভূমিতে বেশী সংখ্যায় ও হারে গবাদি পশু চরানো।
পৃথিবীর ১০০টি দেশে প্রায় ৫ বিলিয়ন হেক্টর জমিতে (৫১,৭২০,০০০ বর্গ কিলোমিটার)
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মরুকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীর এক
তৃতীয়াংশ এলাকা জুড়ে চলছে ভয়াবহ মরুকরণ প্রক্রিয়া। এর ফলে প্রতিবছর ক্ষতি হচ্ছে
প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার, আর এসব জমি পুনরুদ্ধার করতে গেলে প্রতিবছর খরচ হবে ১০
বিলিয়ন ডলার করে। মরুর বিস্তার দেখা দিয়েছে এশিয়াতেও। কৃত্রিম উপগ্রহের সংগৃহীত
তথ্যে দেখা গেছে যে আফ্রিকার ৫৩% এলাকা এবং এশিয়ার ৩৪% এলাকা কোনো না কোনো
মাত্রায় মরময়তায় আক্রান্ত।
জাতিসংঘের হিসেব মতো চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (বাংলাদেশেসহ) ফসলী মাঠগুলো
বদলে যাওয়ায় ১৫ কোটি কৃষক শস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আগে মরুকরণের বিষয়টি
ছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, কিন্তু মানুষের আবির্ভাব ও তার কর্মকান্ডের প্রভাবে
প্রকৃতিকে নিজের করায়ত্তে নেয়ার পর থেকে এ প্রক্রিয়াটি হয়েছে সম্পূর্ণ মনুষ্য
নির্ভর। সাহারা মরুভূমির সৃষ্টি প্রাকৃতিক, কিন্তু সাহেল মরুভূমিসহ পৃথিবীর নানান
জায়গায় মরুকরণ শুরু হয়েছে মানুষের কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে।
বাংলাদেশে মরুময়তার লক্ষণ ও কারণ
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে মরুময়তার সুষ্পষ্ট লক্ষণ দেখা দিয়েছে। উপগ্রহ চিত্র থেকে
পরিষ্কার বোঝা যায় যে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুময়তার করাল থাবা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে মরুময়তার লক্ষণবাংলাদেশে মরুময়তার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে
(১) মাটির উপরের তরে পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া ও ভুরভুরা হয়ে যাওয়া, ফলে গাছপালা
ও উদ্ভিদ জন্মানোর ক্ষমতা হারানো।
(২) তাপমাত্রায় চরম ভাব আসা। রাজশাহী, ঈশ্বরদী প্রভৃতি এলাকায় গরমকালে সর্বোচ্চ ও
শীতকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা প্রাথমিক মরুকরণের লক্ষণ।
(৩) গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া।
(৪) ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া।
(৫) কাঁটা বা ক্যাকটাস জাতীয় গাছের প্রাধান্য পাওয়া।
বাংলাদেশে মরুময়তার কারণ
বাংলাদেশে মরুময় পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে সব কারণকে দায়ী করা হয় সেগুলো নিচে
আলোচিত হলো।
(১) অভিন্ন নদীর উজানে অবকাঠামো নির্মাণের ফলে গতিপথ পরিবর্তন ও যথেচ্ছ পানি
প্রত্যাহারঃ
বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ
নদী ভারতসহ অন্য দেশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এসব
নদীর মধ্যে পদ্মা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উত্তরাঞ্চলীয় জেলা, যেমন- রাজশাহী,
কুষ্টিয়া, পাবনার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদী দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের আর্থ-
সামাজিক জীবনের ও ভু-প্রাকৃতিক পরিবেশের অক্কা।
কিন্তু ভারত মুর্শিদাবাদে ধুলিয়ানের কাছে ফারাক্কায় পদ্মা নদীর উজানে বাঁধ দেয়ায়
এবং এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় পদ্মা ও তার শাখা-নদীগুলোর একাধারে পানি
ধারণ ক্ষমতা ও নিষ্কাশন প্রণালী হিসেবে কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে শুকনো মৌসুমে
প্রবাহ এত কমে যাচ্ছে যে ব্যাপক হারে চর পড়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং
শাখা-নদীগুলোতে চর পড়ে সেগুলোর মুখ কন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পদ্মার পানির উপর ভরসা করে
নির্মিত গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পটিও মূলত ফারাক্কা বাঁধের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। এর
ফলে দেশের ঐ অঞ্চল শুধু ফসল ও সবুজ গাছপালা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না বরং দেখা
দিচ্ছে মরুময়তা।
(২) নদীবাহিত পলিঃ বর্ষাকালে একদিকে আসছে বাড়তি পানি, অন্যদিকে, নদীর
স্রোত কমে যাওয়ায় জমা হচ্ছে তুলনামূলক বেশী পলিমাটি। নদীগর্ভে পলি জমে নদীর
নাব্যতা, পানিধারণ ক্ষমতা ও নিষ্কাশন ক্রিয়া কমিয়ে দিয়েছে। শুকনো মওসুমে নদী
একেবারে শুকিয়ে যাওয়ার ফলে নৌ-চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। পলি জমে নদী ও শাখা নদীগুলোতে
চর গড়ে উঠেছে, দিনদিন তার আকার ও উচ্চতাও বাড়ছে। এতে বালিয়াড়ীর প্রসার ঘটে
মরুময়তাকে ত্বরান্বিত করছে।
(৩) সেচ কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারঃ শুকনো মওসুমে এমনিতেই
নদী-খাল-বিল-পুকুরে পানি কমে যায়। উপরন্তু ফারাকাসহ নদীর বিভিন্ন উজানে
উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় এর প্রতিক্রিয়ায় বৃহত্তর রাজশাহী,
পাবনা, কুষ্টিয়া, খুলনা প্রভৃতি জেলায় সেচের পানি নিতে হয় মাটির নিচ থেকে। অনেক
জায়গায় ধারে কাছে জলাশয় না থাকায় এমনিতেই ভূ-গর্ভ থেকে পানি নিতে হয়। যে পরিমাণ
পানি উত্তোলিত হচ্ছে ভূ-গর্ভের জলধার তা ফেরত পাচ্ছে না।
এতে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। শুকনো মওসুমে উত্তরাঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার পড়ে
যায়। এক সময়ের সবুজ প্রান্তর এখন লতাপাতা, গাছপালা, বৃক্ষশূন্য। নতুন গাছপালা
জন্মাতে পারে না, পুরনো গাছেরও অকাল মৃত্যু ঘটে। ফলে এ অঞ্চল ক্রমশ মানুষ বসবাসের
অযোগ্য হয়ে পড়ছে। উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র বা লালমাটি এলাকা এর আওতায় পড়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে বরেন্দ্র সমন্বিত উন্নয়ন
প্রকল্প হাতে নিতে হয়েছে।
(৪) নির্বিচার বৃক্ষনিধনঃ বিকল্প জ্বালানীর, বিশেষ করে জ্বালানী গ্যাসের,
সরবরাহ না থাকায় উত্তরাঞ্চলের মানুষ জ্বালানী হিসেবে এবং অন্যান্য প্রয়োজনে
নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করছে। এভাবে গাছপালা কেটে ফেললে মাটি উন্মুক্ত হয়ে সরাসরি
সূর্যকিরণে দল হয়, ফলে মাটির পানি বাষ্পীভূত হলে মাটি শুকিয়ে যায়। বাতাসে মাটির
উপরস্তর উড়ে যায়' কিংবা বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়, মাটি হয়ে পড়ে মরুসদৃশ। মধ্য আফ্রিকার
সাহেল (Sahel) অঞ্চলের মরুপ্রবণতাও নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফল। বাংলাদেশের
বরেন্দ্র এলাকায় একই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
(৫) চারণভূমির অভাবঃ দেশের কোখাও পর্যাপ্ত চারণভূমি নেই, তাই গবাদি পশুর
খাদ্য সংকটও প্রকট। নতুন চারা গাছ থেকে শুরু করে ঝোপ-ঝাড়, শস্য সব খেয়ে ফেলে। এতে
নতুন নতুন জায়গা অনাবৃত হয়ে ভূমিক্ষয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এভাবে ক্রমশ মরুপ্রবণ
এলাকার বিস্তার ঘটে।
(৬) বিশ্বজনীন গ্রীন হাউস এফেক্টঃ গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের
অবদান কম হলেও ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশী। ইতোমধ্যেই উষ্ণ আবহাওয়ার বিস্তার লক্ষ্য
করা যাচ্ছে। এ প্রতিক্রিয়া উত্তরাঞ্চলে 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা'- এর মতো অনুভূত
হচ্ছে। একদিকে ফারাক্কা বাঁধ, অন্যদিকে গ্রীন হাউস ইফেক্ট-এ দুই শক্তিশালী
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মতো ছোট আয়তনের, ঘন বসতির, দরিদ্র দেশের পক্ষে
কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা খুঁজে বের করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
মরুকরণের ফলাফল
মরুকরণের ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। এর ফলে একদা চাষযোগ্য, বাসযোগ্য ও গোচারণযোগ্য
তুমি নিষ্ফলা, অনুর্বর হয়ে উঠে। এ অবস্থা যখন চরমে উঠে তখন নির্দিষ্ট দেশে
খাদ্যাভাবসহ আর্থ-সামাজিক পরিবেশ বিশৃজাল হয়ে পড়ে। গোড়াতেই প্রতিকারের উদ্যোগ না
নিলে কোনো দেশের আর্থিক অবকাঠামো ধ্বংসসহ দেশ ও জাতি বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়।
মরুকরণ রোধের উপায়
নিচে মরুকরণ রোধের কার্যকর পদক্ষেপের উল্লেখ করা হলো-
(১) মরুকরণ রোধের প্রধান উপায় হচ্ছে শুষ্ক অঞ্চলে পানিসাম্য বজায় ও ত্বরান্বিত
করার জন্য পর্যাপ্ত বনভূমি সৃষ্টি করা।
(২) হুমকির সম্মুখিন অঞ্চলগুলো যেন আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য জরুরী ভিত্তিতে
পরিবেশগত নিরাপদ, সামাজিকগত গ্রহণীয়, সুষ্ঠু ও আর্থিক দিক থেকে সাধ্য
ভূমি-ব্যবহার পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে হবে।
(৩) দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করার ব্যবস্থা এবং নবায়নযোগ্য চারণভূমি সৃষ্টির
উদ্যোগ নিতে হবে।
(৪) মরুকরণ রোধ কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে হলে স্থানীয় জনগণ, গ্রামীণ সংস্থা,
জাতীয় সরকার, বেসরকারী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ
অপরিহার্য।
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url