ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কি-ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এর উদ্দেশ্য

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) হলো একটি বিশাল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যা বিশ্বের প্রতিটি কোণ থেকে মানুষ, তথ্য এবং পরিষেবাগুলোকে যুক্ত করে। এটি ইন্টারনেটকে ওয়েবসাইট, মিডিয়া এবং যোগাযোগের একটি ইন্টারেক্টিভ জগতে রূপান্তরিত করেছে। শেখা এবং বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া পর্যন্ত, WWW দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কি?

ওয়াল্ড ওয়াইড ওয়েব (সংক্ষেপে ওয়েব বা WWW) ১৯৮৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত Uropean Particle Physics Laboratory-তে তৈরি হয়। শুরুতে এটা তৈরি হয়েছিল অনলাইনে হাইপারটেক্সট ডকুমেন্টে ফুটনোট, ফিগার এবং ক্রস রেফারেন্স নিয়ে কাজ করার জন্য যা Hypertext Transfer Protocol (HTTP) নামক একটি প্রটোকল ব্যবহার করে। একটি হাইপারটেক্সট ডকুমেন্ট হচ্ছে বিশেষ ভাবে এনকোডেড এক ধরণের ফাইল যা Hypertext Markup Language (HTML) ব্যবহার করে। এই Language টি ডকুমেন্ট তৈরিকারীকে ডকুমেন্টে হাইপারটেক্সট লিংক (বা 'হাইপার লিংক' বা শুধু 'লিংক') বসানোর সুযোগ প্রদান করে। HTTP এবং হাইপারটেক্সট লিংক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মূল ভিত্তি। আপনি যদি কখনো ওয়েব ব্যবহার করে থাকেন তাহলে আপনি অবশ্যই HTTP শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছেন। কারণ সকল ওয়েব এড্রেসের প্রথমে HTTP শব্দটি অন্তর্ভুক্ত থাকে।

আপনি যখন স্ক্রীণে কোনো হাইপার টেক্সট ডকুমেন্ট (যাকে সাধারণত ওয়েব পেজ বলা হয়) পড়বেন তখন দেখতে পাবেন অনেক শব্দ বা ছবি হাইপারটেক্সট লিংক হিসাবে এনকোড করা আছে। আপনি যখনই ঐ শব্দ বা ছবিতে ক্লিক করবেন তখনই আপনি অন্য স্থানে বা অন্য পাতায় বা অন্য ওয়েব পেজে যেতে পারবেন। হয় ঐ পেজটি ঐ কম্পিউটারেই মূল পেজ হিসাবে বিদ্যমান বা ইন্টারনেটের যে কোনো স্থানে অবস্থিত। যেহেতু ব্যবহারকারীকে নতুন স্থানে বা পেজে যাবার জন্য আলাদা কোনো কমান্ড শিখতে হয় না বা ভিন্ন কোনো এড্রেস জানতে হয় না সেহেতু বলা যায় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত ছড়ানো ছিটানো রিসোর্সগুলো একটি স্থানে সংগঠিত করেছে।

আপনি হয়তো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এবং ইন্টারনেট শব্দটি একই অর্থে ব্যবহার করতে শুনেছেন। কিন্তু ওয়েব হচ্ছে ইন্টারনেটের অসংখ্য সার্ভিসের মধ্যে একটি সার্ভিস মাত্র।

ওয়েবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ওয়েব ১৯৮৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের একটি পদার্থবিজ্ঞান ল্যাবরেটরী CERN এ জন্ম হয়। সেখানে “টিম বার্নার্স-লি” (Tim Berners-Lee) নামক একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ সর্বপ্রথম, নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হাইপার টেক্সট পদ্ধতিতে বিভিন্ন ডকুমেন্টকে পরস্পর সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। সে এবং তার বন্ধু “রবার্ট সেইলি” মিলে পরীক্ষামূলকভাবে এ রকম একটি হাইপার টেক্সট সংযোগ তৈরি করে এবং তা যাচাই করার জন্য উন্মুক্ত করে। প্রথমে কয়েক বছর ওয়েব পেজ ছিলো কেবল টেক্সেটের। বিশ্বে ওয়েবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় ১৯৯২ সালে যখন প্রথম গ্রাফিকাল ব্রাউজার-NCSA Mosaic উদ্ভাবিত হয়। এটি ওয়েবকে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। বর্তমানে ওয়েবের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন এবং পরিবর্তন তদারকীর দায়িত্বে আছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কনসর্টিয়াম (W3C) নামক একটি আন্তজার্তিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এর উদ্দেশ্য

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মূল উদ্দেশ্য হলো তথ্য আদান-প্রদানকে সহজ, দ্রুত এবং সর্বজনীন করে তোলা। WWW মূলত গবেষকদের দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানে সহায়তা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু শীঘ্রই এটি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত একটি বিশ্বব্যাপী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। WWW ব্যক্তি, ব্যবসা এবং সংস্থাগুলোকে ভৌগোলিক বাধা ছাড়াই তথ্য প্রকাশ এবং অ্যাক্সেস করার অনুমতি সুযোগ করে দিয়েছে, যা বিশ্বকে একটি সত্যিকারের কানেক্টেড ডিজিটাল কমিউনিটিতে পরিণত করে।

ওয়েব যোগাযোগের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করে। ওয়েবসাইট, ইমেল, ফোরাম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং জ্ঞান, মতামত এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নিতে পারে। WWW-এর আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো অনলাইন কোর্স, ডিজিটাল লাইব্রেরি এবং বৈজ্ঞানিক রিসোর্সে অ্যাক্সেস প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে সমর্থন করা।

ব্যবসায়িক জগতে, WWW অনলাইন শপিং, ব্যাংকিং, বিজ্ঞাপন এবং অসংখ্য ডিজিটাল পরিষেবা প্রদান করে যা বিশ্ব অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করেছে। এটি স্ট্রিমিং, গেমিং, গান এবং ভিডিওর মাধ্যমে বিনোদনও প্রদান করে। সামগ্রিকভাবে, WWW এর উদ্দেশ্য হলো একটি উন্মুক্ত, অ্যাক্সেসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেখানে যে কেউ শিখতে, যোগাযোগ করতে, কাজ করতে এবং কোন কিছূ তৈরি করতে পারে।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের কাজ

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ব্যতিত ইন্টারনেট কল্পনা করা যায় না। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে যা ডিজিটাল যুগে মানুষ কীভাবে শেখে, যোগাযোগ করে এবং কীভাবে কাজ করে তা নির্ধারণ করে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, তথ্যের জগতে প্রবেশের সর্বজনীন প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। মাত্র কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে, ব্যবহারকারীরা টেক্সট, ছবি, ভিডিও এবং ইন্টারেক্টিভ টুল সহ ওয়েবপৃষ্ঠাগুলো ভিজিট করতে পারেন। তাৎক্ষণিকভাবে জ্ঞানের রাজ্যে অ্যাক্সেস করার এই ক্ষমতা - তা অধ্যয়ন, কাজ বা কৌতূহলের জন্যই হোক না কেন - ওয়েবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলোর মধ্যে একটি। নিম্নে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের কাজগুলো বর্ণনা করা হলোঃ

হাইপারলিংকের মাধ্যমে তথ্য সংযুক্ত

WWW-এর আরেকটি প্রধান কাজ হল হাইপারলিংকের মাধ্যমে তথ্য সংযুক্ত করা। হাইপারলিংকগুলো ডিজিটাল সেতুর মতো কাজ করে, যেখানে ব্যবহারকারীরা সহজেই এক ওয়েবপৃষ্ঠা থেকে অন্য ওয়েবপৃষ্ঠায় ভিজিট করতে দেয়। এই আন্তঃসংযুক্ত কাঠামোর (Interconnected Structure) কারণে, ওয়েব একটি বিশাল ভার্চুয়াল মানচিত্রের মতো মনে হয় যেখানে প্রতিটি তথ্য অন্য কিছুর সাথে সংযুক্ত থাকে, যা একটি সহজ এবং স্বজ্ঞাত ব্রাউজিং অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

গ্লেবাল কমিউনিকেশন সাপোর্ট

বিশ্বব্যাপী যোগাযোগকে সাপোর্ট করার ক্ষেত্রে WWW একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ইমেল, অনলাইন বার্তা, ভিডিও কনফারেন্সিং, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং আলোচনা মূলক ফোরামগুলোকে সক্ষম করে, যার ফলে মানুষ রিয়েল টাইমে বিশ্বের যে কোন ব্যক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এই কাজটি পরিবারগুলোর যোগাযোগের ধরণ, ব্যবসা পরিচালনার ধরণ এবং কমিউনিটি গুলো কীভাবে ধারণা শেয়ার করে নেয় সেগুলোকে ত্বরান্বিত করেছে।

অনলাইন লেনদেন এবং পরিষেবা

WWW-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল অনলাইন লেনদেন এবং পরিষেবাকে সহজতর করা। কেনাকাটা এবং ব্যাংকিং থেকে শুরু করে ভ্রমণ টিকিট বুকিং এবং অনলাইন ফর্ম জমা দেওয়া পর্যন্ত, ওয়েব ব্যবহারকারী এবং সার্ভারের মধ্যে তথ্য নিরাপদে স্থানান্তর করতে সাহায্য করে। এই ইন্টারেক্টিভ ক্ষমতাই আধুনিক ই-কমার্স, অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল কর্মক্ষেত্রগুলোকে বাস্তবে রুপ দিতে সাহায্য করেছে।

ক্রিয়েটিভ ও পাবলিশিং প্ল্যাটফর্ম

ওয়েব একটি ক্রিয়েটিভ ও পাবলিশিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে পেশাদার সকলেই ওয়েবসাইট, ব্লগ, পোর্টফোলিও বা মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে এবং তাদের ধারণা বিশ্বের সাথে শেয়ার করে নিতে পারে। কন্টেন্টের এই গণতন্ত্রীকরণ (Democratization) লক্ষ লক্ষ মানুষকে কণ্ঠস্বর দিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করেছে।

মাল্টিমিডিয়া অভিজ্ঞতা

এছাড়াও, WWW মাল্টিমিডিয়া অভিজ্ঞতা সাপোর্ট করে শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। ভিডিও, অ্যানিমেশন, ভার্চুয়াল ট্যুর এবং ইন্টারেক্টিভ সিমুলেশন শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় এবং সহজলভ্য করে তোলে। কেউ নতুন দক্ষতা শিখতে, টিউটোরিয়াল দেখতে, অথবা বৈজ্ঞানিক ধারণা খুঁজতে চায়, সেক্ষেত্রে, ওয়েব সকল ধরণের শিক্ষার্থীর জন্য সমৃদ্ধ তথ্য, রিসোর্স সরবরাহ করে।

সামগ্রিকভাবে, WWW-এর কাজগুলো হলো তথ্য অ্যাক্সেস করা, মানুষকে সংযুক্ত করা, লেনদেনকে সাপোর্ট করা, সৃজনশীলতা সক্ষম করা এবং শিক্ষা বৃদ্ধি করা। একসাথে, এই কাজগুলো ওয়েবকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রূপান্তরকারী হাতিয়ারগুলোর মধ্যে একটি করে তুলেছে।

আপনি যদি ওয়েবের ইতিহাস আরো বিশদভাবে জানতে চান তাহলে নিচের সাইটগুলো ব্রাউজ করুন।
www.w3.org/history.html
WDVL.com/Internet/History

সচরাচর জিজ্ঞাসাঃ

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কত সালে আবিষ্কৃত হয়?

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ১৯৮৯ সালে টিম বার্নার্স-লি আবিষ্কার করেছিলেন।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কবে চালু হয়?

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ১৯৯১ সালে জনসাধারণের জন্য চালু করা হয়।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক কে?

টিম বার্নার্স-লিকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক বলা হয়।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের উদ্ভাবক কে?

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কার করেছিলেন ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স-লি।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে এর প্রতিষ্ঠাতা কে?

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন টিম বার্নার্স-লি।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব কিভাবে তৈরী হয়?

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তিনটি মূল প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছিল - HTML (হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ), HTTP (হাইপারটেক্সট ট্রান্সফার প্রোটোকল) এবং URL (ইউনিফর্ম রিসোর্স লোকেটার)। টিম বার্নার্স-লি CERN-এ এই প্রযুক্তিগুলো তৈরি করেছিলেন যাতে গবেষকরা সহজেই তথ্য শেয়ার করে নিতে এবং অ্যাক্সেস করতে পারেন। তিনি প্রথম ওয়েব ব্রাউজার এবং প্রথম ওয়েব সার্ভার তৈরি করেছিলেন, যা একসাথে আধুনিক ওয়েবের ভিত্তি তৈরি করেছিল।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url