ই গভর্ন্যান্স বলতে কি বোঝায়-ই গভর্ন্যান্স ও বাংলাদেশ

ই-গভর্ন্যান্স কনসেপ্টটি বিশ্বে বহুল আলোচিত বিষয় গুলোর মধ্যে একটি। গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে সারা বিশ্বে ই-গভর্ন্যান্স কনসেপ্টটি নিয়ে আলোচনা করা হলেও এটি বেশ প্রাথমিক অবস্থাতেই আছে।

আর্টিকেলে যা থাকছেঃ- ই গভর্ন্যান্স কি?-ই গভর্ন্যান্স ও বাংলাদেশ

ই-গভর্ন্যান্স কি?
ই গভর্ন্যান্স এর সুবিধা
ই-গভর্ন্যান্স ব্যবহারের ক্ষেত্র
ই-গভর্ন্যান্স এর মাধ্যমে প্রদানকৃত সেবা
ই-গভর্ন্যান্স ও বাংলাদেশ

ই-গভর্ন্যান্স কি?

তথ্য এবং সেবা বিতরণের মান উন্নয়ন করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং সরকারকে অধিকতর স্বচ্ছ, জবাবদিহীতামূলক এবং কার্যকর করার লক্ষে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) ব্যবহার ব্যবস্থাকে বলা হয় ই-গভার্নেন্স। তৃণমূল পর্যায়ে টেলিযোগাযোগ পৌঁছে দেয়ার কাজ করে এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রুরাল টেলিকমিউনিকেশনস কংগ্রেস’-এর ওয়েবসাইটে ই-গভর্ন্যান্সের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে-

E-Governance is the efficient delivery of government. E-Governance is using the internet to facilitate effective decision making in the community এর আভিধানে 'গভর্ন্যান্স' শব্দটির অর্থ করা হয়েছে শাসন বা পরিচালন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি। এখন স্বাভাবিকভাবেই যখন একটি দেশের সরকারের শাসন বা পরিচালন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের সাহায্যে করা হয় তখনি একে প্রচলিত পরিভাষায় ই-গভর্ন্যান্স বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মাধ্যম হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইন্টারনেট। আর এর পাশাপাশি অন্যান্য মাধ্যম ও রয়েছে।

ই গভর্ন্যান্স এর সুবিধা

ই-গভর্ন্যান্স কনসেপ্টটি সারা পৃথিবীতে বিগত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও এখনো কিন্তু এটি বেশ প্রাথমিক অবস্থাতেই আছে। কেননা উন্নত দেশগুলোতে ই-গভর্ন্যান্স এর বেশ প্রচলন হলেও বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ দেশে এটি এখনো অনেকটাই প্রাথমিক অবস্থায় আছে। আর উন্নত দেশগুলোতেও ই-গভর্ন্যান্স একটি মিশ্র সরকারি ব্যবস্থার অঙ্গ হয়েই আছে। অর্থাৎ দেশগুলোতে একই সাথে সনাতন ও আধুনিক ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা-দুই ধরণের শাসন পরিচালনা পদ্ধতিই বিদ্যমান। এখনো পর্যন্ত কোনো দেশেই শুধুমাত্র ই-গভর্ন্যান্সভিত্তিক সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যায়নি।

আর উন্নত দেশগুলোতে ই-গভর্ন্যান্স বেশ প্রসার ঘটলেও তাকেও পূর্ণাঙ্গ ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা বলা যায় না। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ দেশেই সরকারি সেবা দেয়ার ক্ষেত্রেই ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা সীমিত। ই-গভর্ন্যান্স হলো ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে শাসন বা পরিচালন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি। একটি দেশের ব্যাপক দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। সেক্ষেত্রে ই-গভর্ন্যান্স এর মাধ্যমে মূল যে সুবিধা পাওয়া যায় তা হলো এর মাধ্যমে সরকার ও জনগণের মধ্যে একটি স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দুর্নীতি ব্যাপকভাবে কমানো যায়।

তাই জনগনের কল্যাণে জরুরি ভিত্তিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের সহায়তায় ই-গভর্ন্যান্স প্রচলনের মাধ্যমে জনমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া ই-গভর্ন্যান্স এর মাধ্যমে অকল্পনীয় পরিমাণে দক্ষতা বাড়ানো যায়। আর এটি ব্যাপক পরিমাণে দারিদ্রদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রেও সহায়ক। ই-গভর্ন্যান্স প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া ধরে রাখা ও আরো এগিয়ে নেয়া, মানবসম্পদ উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা ও এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কৌশল প্রণয়ন করা যায়।

ই-গভর্ন্যান্স ব্যবহারের ক্ষেত্র

E-Governance-এর ব্যবহার ব্যাপক। সুতরাং এর ব্যবহারের ক্ষেত্রও ব্যাপক। খুব কম সেক্টরই আছে যেখানে E-Governance-এর ব্যবহার করা যায় না। E-Governance-এর মূল উপাদান চারটি। অর্থাৎ চারটি প্রধান ক্ষেত্রে মূলত E-Governance-পরস্পরের মধ্যে মিক্সক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করে। এগুলো হলো-
১. সরকার ও জনগণ
২. সরকার ও সরকার
৩. সরকার ও তথ্য
৪. সরকার ও ব্যবসা সম্প্রদায়।
মূলত এই ক্ষেত্রগুলোতেই E-Governance-প্রচলিত হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে পৃথিবীর যেসব দেশে E-Governance-প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশ দেশের সরকার ও জনগণ এবং সরকার ও ব্যবস্য সম্প্রদায়ের মধ্যকার E-Governance-প্রচলিত রয়েছে।

ই-গভর্ন্যান্স এর মাধ্যমে প্রদানকৃত সেবা

বর্তমানে E-Governance ব্যাপক পরিসরে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্যাক্স পরিশোধ, ড্রাইভিং ও অন্যান্য লাইসেন্স ইস্যু করা, মটরগাড়ির লাইসেন্স প্রদান, পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন, পরীক্ষা প্রক্রিয়া পরিচালনা করা, পাসপোর্ট ইস্যু করা, টেন্ডার প্রক্রিয়া পরিচালনা, সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা। যেমন-শিল্পনীতি, বাণিজ্যনীতি, শিক্ষানীতি, পরিবেশনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জনগণকে জানানো, বিভিন্ন ইস্যু সম্পর্কে জনগণের মতামত গ্রহণ, বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সরাসরি জনগণের কাছ থেকে জানা, সরকারের প্রদত্ত বিভিন্ন সেবা প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান, জমির দলিল রেজিস্ট্রেশন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংরক্ষণ করা, উন্নয়ন প্রক্রিয়া মনিটর করা, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান ও জরিপ পরিচালনা করা এবং তা জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে অটোমেশনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ স্থাপন, প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় সরকারী বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন ইত্যাদি।

ই-গভর্ন্যান্স ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ই-গভর্ন্যান্স প্রচলন নিয়ে কথা হচ্ছে বিগত প্রায় এক দশক ধরেই। তবে এতদিন তেমন কাজ না হলেও সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু করে কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ই-গভর্ন্যান্স বিষয়ক বেশকিছু কার্যক্রম সরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন আছে। এ কার্যক্রমগুলো সমন্বয় করছে "সাপোর্ট টু আইসিটি টাস্কফোর্স প্রোগ্রাম প্রোজেক্ট" নামের একটি প্রকল্প যা মূলত কাজ করছে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন “পরিকল্পনা কমিশন”। সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়; যেমন-স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, ভূমি, তথ্য, শ্রম ও জনশক্তি, পররাষ্ট্র এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু সেবা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে ফলে ই-গভর্ন্যান্সের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। সরকার ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে মূলত যে সেবাগুলো প্রদান করবে বা করছে সেগুলো হলো-

মেইল সার্ভিসঃ ই-গভর্ন্যান্সের আওতায় ইলেক্ট্রনিক মেইলিং সিস্টেম চালু করা। ফলে এর মাধ্যমে যে কোনো যোগাযোগ সময় ও অর্থের যথেষ্ট সাশ্রয় হবে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ডেস্কগুলোর উৎপাদনশীলতাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।

এফটিএসঃ ই-গভর্ন্যান্সের আওতায় একটি কার্যকর এফটিএস বা ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম প্রবর্তনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন অনিয়ম ও বিশৃংখলা দূর করা এবং কোনো ফাইল প্রসেসিংয়ে আরো উন্নত নিয়ন্ত্রণ ও সুপারভিশন নিশ্চিত করার নিমিত্তে একটি নতুন ও কার্যকর ইলেক্ট্রনিক ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

ইন্ট্রানেট পোর্টালঃ বাংলাদেশ সরকারও ই-গভর্ন্যান্স ব্যবস্থার আওতায় একটি ইন্ট্রানেট পোর্টাল করার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। ফলে একই জায়গায় অবস্থান করে বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ছাড়াও ইলেক্ট্রনিক শেয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট, বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ঘোষণা, আলোচনা, নিউজ সার্ভিস, ওয়েব মেইল চেকিং এবং অন্যান্য অনেক সেবা প্রদান সম্ভব হবে। এর ফলে সরকারী কর্মকর্তারা একটি একক যোগাযোগ স্থান থেকেই অনেকগুলো সেবাগ্রহণ করতে সক্ষম হবেন।

ভিডিও কনফারেন্সিংঃ গ্রুপ ডিসকাশন সাপোর্ট সিস্টেম (জিডিএসএস) মূলত একটি আধুনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে যে কোনো গ্রুপ ডিসকাশন সরাসরি না করে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর সাহায্যে আরো উন্নত উপায়ে করা যায়। এ কারণে বাংলাদেশ সরকারও দ্রুত, সহজ ও কম খরচে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য ই-গভর্ন্যান্সের আওতায় জিডিএসএস চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করছে।

সমন্বিত ডাটাবেজ সাপোর্টঃ সত্যিকার অর্থেই সরকার এখন একটি সমন্বিত ডাটাবেজ সাপোর্ট ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। কেননা, সরকারকে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে বিভিন্ন ধরণের প্রচুর ও বিচ্ছিন্ন ডাটা ও তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয়। এখন এই বিভিন্ন প্রকৃতির এবং বিচ্ছিন্ন ডাটা ও তথ্যগুলোকে এক জায়গায় সমন্বিত করা খুবই জরুরী। তাই সরকার একটি কার্যকর ই-গভর্ন্যান্স প্রক্রিয়া গড়ে তোলার স্বার্থে এর সহায়ক হিসেবে অচিরেই একটি সমন্বিত ডাটাবেজ সাপোর্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ঃ কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই একটি ইনফরমেশন সিস্টেম ব্যবহার করে বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন বাজারের কৃষিজাত পণ্য সম্পর্কে বাজার তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই সিস্টেমের আওতায় প্রতিদিন ই-মেইলের মাধ্যমে তথ্য ইলেকট্রনিকভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে এই ইনফরমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে কৃষক ও কৃষি পণ্য বাজারজাতকারীরা বিভিন্ন বাজারে কৃষি পণ্যের দামের তুলনামূলক চিত্র ও আনুসংগিক মূল্যবান তথ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন, কৃষকেরা বাজারের পরিস্থিতি বিচার করে তাদের কৃষিপণ্য উৎপাদন সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত (কখন কোন ফসল উৎপাদন করবেন, কখন কোনটি করবেন না, কখন পণ্য বিক্রি করবেন, কখন ফসল গুদামজাত করে রাখবেন ইত্যাদি) নিয়ে তাদের মুনাফা অনেক বাড়াতে সক্ষম হবেন এবং এর পাশাপাশি নীতি-নির্ধারকগণ ও গবেষকরা বিভিন্ন সূচক ও তাঁর প্রভাব বিচার-বিবেচনা করে ভবিষ্যতের জন্য নীতি ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ সক্ষম হবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান প্রক্রিয়ায় দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রক্রিয়ায় ব্যাপক জটিলতা বিরাজমান। বর্তমান ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর এসএসসি, এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন স্ট্যাটাস, পরীক্ষা কেন্দ্রের অবস্থান, পরীক্ষার ফলাফল জানা ইত্যাদি তথ্য প্রাপ্তির প্রক্রিয়া বেশ কষ্টসাধ্য। তাছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার আবেদন ফর্ম সংগ্রহ করা বেশ সময় সাপেক্ষ্য এবং অনেক সময় খরচ সাপেক্ষ্যও বটে। এই সকল সামগ্রিক সমস্যাসমূহ উত্তরণের জন্য সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সরকারের "সাপোর্ট টু আইসিটি টাস্কফোর্স প্রোগ্রাম প্রোজেক্ট (এসআইসিটি)"-এর আওতায়।

এ প্রজেক্টের আওতায় প্রাথমিকভাবে সকল পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট তথ্যগুলোকে অনলাইনে প্রাপ্তির সুবিধা প্রদান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ধরণের ফর্ম অনলাইনে প্রাপ্তির ব্যবস্থা, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিস ও দপ্তরের মধ্যে যাতে প্রয়োজনীয় ডাটা আদান-প্রদান করা যায় এবং জেলা পর্যায় পর্যন্ত ডাটা এন্ট্রির কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীয়করণের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় এবং বৈদেশিক কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ঃ বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে বেকারত্বের সমস্যা একটি বড় সমস্যা। এই বিপুল বেকারত্বের সমস্যা শুধু দেশেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য বিদেশেও এদের কর্মসংস্থানের চাহিদা ও সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। কিন্তু বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্পর্কে সিংহভাগ সাধারণ জনগণই অবগত নন। তাই তাদের জন্য দেশের পাশাপাশি বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ, শ্রম আইন, কর্মীর অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক অবগত করানো, তথ্য জানানো প্রয়োজন। আর জনগনকে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জানানোর ক্ষেত্রে ইন্টারনেট একটি অন্যতম সফল মাধ্যম হতে পারে বলে সরকার মনে করে।

কেননা, দেশের সবগুলো জেলা শহর এবং অনেকগুলো উপজেলায় এখন ইন্টানেট ব্যবহারের সুযোগ তাই যদি দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নিয়ে একটি ইন্টারএ্যাকটিভ ওয়েবসাইট তৈরি করা যায় পৌঁছে গেছে। তবে অন্তত শহরাঞ্চলের শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে বলে সরকার মনে করছে। সরকার জরুরি ভিত্তিতে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্মরত দুইটি মন্ত্রণালয়-শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় এবং বৈদেশিক কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ইন্টারএ্যাকটিভ ওয়েবসাইটসহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কর্মকান্ড গ্রহণ করছে। সরকারের "সাপোর্ট টু আইসিটি টাস্কফোর্স প্রোগ্রাম প্রোজেক্ট (এসআইসিটি)"-এর আওতায় এই উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ঃ বাংলাদেশে পাসপোর্ট ইস্যুর পুরো প্রক্রিয়াটিই সেকেলে। এটি মূলত পরিচালিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। ইদানীং পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ব্যাপক প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থায় আগ্রহী নাগরিকদের সবসময় যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয় এবং অযথা অনেক সময় অপচয় হয়। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে যদি প্রযুক্তিভিত্তিক ও আধুনিকায়ন করা যায় তাহলে এক্ষেত্রে নাগরিক হয়রানি এবং সময়ের অপচয় প্রায় থাকবে না বললেই চলে। মূলত এই কারণেই সরকার ‘সাপোর্ট টু আইসিটি টাস্কফোর্স প্রোগ্রাম প্রজেক্ট (এসআইসিটি)”-এর আওতায় এই ব্যাপক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পাসপোর্ট ইস্যু ব্যবস্থায় আধুনিকায়নে সরকার যেসব গরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে-ঢাকা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজেশন করা যেখানে প্রতিটি বিভাগ ল্যানের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকবে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ঃ বাংলাদেশের ভূমি রেকর্ড ডকুমেন্টগুলো মূলত ভূমির ওপর মানুষের অধিকারের দলিল যা প্রণীত হয় খতিয়ান ও মৌজার ম্যাপের ওপর ভিত্তি করে। আর এই মূল্যবান রেকর্ডগুলো এতদিন তৈরি ও সংরক্ষণ করা হয়েছে সাধারণ কাগজের মাধ্যমে। আর এর ফলে এই মূল্যবান রেকর্ড ও দলিলগুলোর এখন প্রায় সবগুলিরই খুবই জরাজীর্ণ অবস্থা। অথচ বিভিন্ন ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিস্পত্তিতে অনেক সময় দেখা যায় ১শ বছরেরও বেশি পুরনো ভূমি রেকর্ডেও সাহায্য নিতে হয়। আবার বর্তমানে প্রচলিত কোনো নির্দিষ্ট খতিয়ানের দলিল খোঁজা এবং খতিয়ানের সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করতে অনেক লম্বা সময় লেগে যায়।

আর হাতে হাতে হস্তান্তর করতে করতে কাগজের তৈরি বহু বছরের পুরনো দলিলগুলো অনেক সময়ই নষ্ট হয়ে যায়। এই সমস্যা উত্তরণে ভূমিন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক সময়ে "সাপোর্ট টু আইসিটি টাস্কফোর্স প্রোগ্রাম প্রজেক্ট (এসআইসিটি)"-এর আওতায় মানিকগঞ্জ জেলায় একটি পাইলট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। মানিকগঞ্জের এই পাইলট প্রকল্পটি সফল হলে পরবর্তী সময়ে পুরো দেশে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। সরকার আশা করছে, ডিজিটাল আর্কাইভের মাধ্যমে দামি এই ঐতিহাসিক ভূমি রেকর্ডগুলো আরো ভালোভাবে এবং অধিক নিরাপদে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ঃ বাংলাদেশের টেলিফোন অফিসগুলোর কর্মকান্ড এখন সম্পূর্ণ অটোমেটেড নয়। এ কারণে টেলিফোন ব্যবহারীদের নানারকম ঝামেলা ও হয়রানি। যেমন-দেরিতে বিল প্রাপ্তি, ভুল বিল প্রাপ্তি, গ্রাহক সেবার অভাব ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণ এবং আরো দক্ষতার সাথে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অনলাইনভিত্তিক সেবা ব্যবস্থা একটি ভালো উপায় হতে পারে বলে সরকার মনে করে।

আর এ লক্ষেই সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় "সাপোর্ট টু আইসিটি টাস্কফোর্স প্রোগ্রাম প্রজেক্ট (এসআইসিটি)"-এর আওতায় ঢাকার শেরেবাংলা নগর টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে অটোমেশনে নিয়ে যাওয়ার একটি পাইলট প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে। সরকার শেরেবাংলা নগর টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে পাইলট প্রকল্প ধরে এসআইটি প্রজেক্টের মাধ্যমে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে-জিএম (উত্তর) এর অফিস ও রাজস্ব অফিসকে পুরো কম্পিউটারাইজেশন, জিএম (উত্তর)-এর অফিস ও রাজস্ব অফিসের মধ্যে ল্যান সেট আপ প্রতিস্থাপন করা।

শেরেবাংলা নগর টেলিফোন এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন টেলিফোন লাইনের ডাটা স্টোর করা ও আপডেটের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ প্রতিষ্ঠা, সার্চিং, কুয়েরী ও সর্টিং-এর জন্য ইউজার ফ্রেন্ডলি ইন্টারফেসসহ একটি রেকর্ড সংরক্ষণের সফটওয়্যার ডেভেলপ করা, প্রতিটি গ্রাহকের বিল তৈরি ও বিল পরিশোধের রেকর্ড রাখার জন্য একটি বিলিং সফ্টওয়্যার ডেভেলপ করা, একটি ইন্টারএ্যাকটিভ ওয়েবপেইজ তৈরি করা যা ব্যবহার করে জনগন বিল সংক্রান্ত তথ্য; যেমন-বিলেয় প্রদেয় অর্থের পরিমাণ, পেমেন্ট স্ট্যাটাস, নতুন টেলিফোন। সংযোগের জন্য অনলাইন আবেদন ফরম, টেলিফোন লাইনের ডাটা এন্ট্রি, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করা ইত্যাদি পেতে পারে।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ঃ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ও ই-গভর্ন্যান্স প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি), যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড (ডিটিসিবি)। ইতিমধ্যেই যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ই-গভর্ন্যান্স ও আইসিটি প্রচলনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টের জন্য একটি সুবিধাজনক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম চালু করা, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের মধ্যে লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন করা, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের মধ্যে রেডিও লিংক স্থাপন করা, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ পাঁচটি বিভাগের জন্য তৈরি করা হয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইট। এর পাশাপাশি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ই-গভর্ন্যান্স প্রচলনে একটি শক্তিশালী আইসিটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি কাজ করছে।

বিনিয়োগ বোর্ডঃ সম্প্রতি সরকারের দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগ বোর্ড ও ই-গভর্ন্যান্স চালু করেছে। এজন্য তারা প্রতিষ্ঠা করেছে একটি সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট যা থেকে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অনেক তথ্য ও নির্দেশনা পাবেন। এই ওয়েবসাইটটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে রয়েছে একটি কার্যকর 'অনলাইন সার্ভিস ট্রট্র্যাকিং সিষ্টেম'। এই ট্রট্র্যাকিং সিষ্টেম ব্যবহার করেও বিনিয়োগকারীরা একবার তাদেও বিনিয়োগ প্রোফাইল জমা দেয়ার পর এটি সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদনের জন্য কত সময় লাগবে, প্রোফাইলটি বর্তমানে কার কাছে আছে, কী অবস্থায় আছে ইত্যাদি তথ্য জানা যাবে।

এছাড়া এই সাইটে একজন বিদেশী বিনিয়োগকারী যার বাংলাদেশে ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো নিয়ম-কানুন জানা নেই, তার জন্য চমৎকারভাবে ছকের সাহায্যে দেখানো হয়েছে কীভাবে তিনি এ দেশে ব্যবসা প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন, এজন্য কী কী ফরমালিটি সম্পন্ন করতে হবে এবং এর পাশাপাশি রয়েছে কী কী খাতে বিনিয়োগ করতে হতে পারে ইত্যাদি। এই সাইটে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় নয়টি শিল্প খাতে বিনিয়োগ সম্ভাবনা সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। এগুলো হলো-বস্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক শিল্প, হিমায়িত খাদ্য, চামড়া, সিরামিকস, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষিভিত্তিক শিল্প ও ইলেক্ট্রনিকস। বিনিয়োগকারীদের জন্য এদেশে ব্যবসা শুরু করার একটি গাইডও পাওয়া যাবে এই সাইটে। সবমিলিয়ে এই সাইটটি একটি কার্যকর সাইট।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url