বাস্তুতন্ত্র কাকে বলে - বাস্তুতন্ত্রের উপাদান-বাস্তুতন্ত্রের গঠন ও কার্যাবলী
    বাস্তুতন্ত্র/ইকোসিস্টেম হল জীবন্ত সম্প্রদায়ের মতো যেখানে বিভিন্ন জীব এবং
    তাদের আশেপাশের পরিবেশ এবং নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার
    মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
    বাস্তুতন্ত্র এমন একটি পরিবেশ যেখানে গাছপালা, প্রাণী এবং অণুজীবগুলি একটি
    ভারসাম্যপূর্ণ এবং সুরেলা পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা পালন করে।
  
  সূচিপত্রঃ- বাস্তুতন্ত্র কাকে বলে - বাস্তুতন্ত্রের উপাদান-বাস্তুতন্ত্রের গঠন ও কার্যাবলী
- বাস্তুতন্ত্র কাকে বলে
- বাস্তুতন্ত্রের উপাদান
- বাস্তুতন্ত্রের গঠন ও কার্যাবলী
বাস্তুতন্ত্র কাকে বলে
    বাস্তুতন্ত্র এর ইংরেজি হলো Ecosystem। বাস্তুতন্ত্র হলো জৈব, অজৈব পদার্থ ও
    বিভিন্ন জীবসমন্বিত একটি প্রাকৃতিক একক। যেখানে বিভিন্ন জীবসমষ্টি পরস্পরের
    সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে
    একটি জীবনধারা গড়ে তোলে। জীব ও তার পরিবেশের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক চর্চার
    বিষয়কে বাস্তুবিদ্যা বা ecology বলে। ইকোসিস্টেম হল বাস্তব্যবিদ্যার একটি
    কাঠামোগত এবং কার্যকরী একক।
  
  বাস্তুতন্ত্রের উপাদান || Components of ecosystem
    প্রকৃতি দুটি উপাদান নিয়ে গঠিত। একটি হচ্ছে সজীব বস্তু, অন্যটি তার পরিবেশ।
    উপাদানদুটি শুধু জটিল, নিখুঁত আর গতিময়ই নয়, বরং আন্তঃনির্ভর, পারস্পরিক
    ক্রিয়াশীল এবং আন্তঃসম্পর্কিতও বটে। বাস্তব্যবিদ্যায় সজীব বন্ধু আর তাদের
    পরিবেশের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়েই আলোচনা করা হয়। দুটি গ্রীক শব্দ নিয়ে Ecology
    বা বাস্তব্যবিদ্যা শব্দ গঠিত হয়েছে। oikos বাস্তু। বাড়ি logos জ্ঞান/ অধ্যয়ন।
    মানুষের জীবনের নানা প্রকৃতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাস্তব্যবিদ্যার সাথে
    সম্পর্কিত। মানবকল্যাণে বাডুবিদ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তা ছাড়া কৃষি
    (শস্য আবর্তন, আগাছা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি), তৃণভূমি ব্যবস্থাপনা (চারণভূমি
    ব্যবস্থাপনা), বন বিদ্যা, জৈবনিক জরিপ, পেস্ট নিয়ন্ত্রণ, মাৎস্যবিদ্যা, পরিবেশ
    দূষণ এবং মাটি, পানি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণেও বাস্তব্যবিদ্যা গুরুত্বপূর্ণ
    ভূমিকা পালন করে।
  
    বাস্তুগত উপাদানগুলো মিলে তৈরি করে পরিবেশ। পরিবেশ অর্থ চারপাশ। অর্থাৎ একটি
    জীবের চতুর্দিক বেষ্টনকারী যাবতীয় উপাদান (আলো, তাপ, মাটি, পানি ও অন্যান্য
    জীব) মিলে পরিবেশ তৈরি হয়। যে কোনো বাহ্যিক শক্তি, পদার্থ বা অবস্থা যা জীবের
    চারদিক ঘিরে থাকে এবং জীবের জীবনযাত্রাকে কোনো না কোনো উপায়ে প্রভাবিত করে,
    তা-ই হবে ঐ জীবের পরিবেশের একটি উপাদান। এসব উপাদান পরিবেশিক উপাদান বা
    বাস্তবাগত উপাদান বা সোজা কথায়, উপাদান নামে পরিচিত। পরিবেশিক উপাদানগুলো অজীব
    ও সজীব দুধরনের। অজীব ও সজীব উপাদানগুলো মিলে তৈরি করে জীবের পরিবেশ।
    বাস্তব্যবিদ্যার মৌলিক কার্যকরী একককে বাস্তুতন্ত্র (ecosystem) বলে।
  
  বাস্তুতন্ত্রের উপাদানসমূহ
    প্রতিটি বাস্তুতন্ত্র প্রধানত ২ টি উপাদান নিয়ে গঠিত। উপাদান ২ টি নিম্নে
    বর্ণনা করা হলো।
  
  (ক) অজীব উপাদান
  (খ) সজীব উপাদান
  চিত্রঃ বাস্তুতন্ত্রের উপাদান (চার্ট)
  অজীব উপাদান
    অজীব উপাদানে পরিবেশের মৌলিক অজৈব, জৈব ও ভৌত উপাদান অন্তর্ভুক্ত।
  
  
    (১) অজৈব উপাদানঃ পরিবেশের অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন,
    ক্যালসিয়াম, সালফার, ফসফরাস, অ্যামিনো অ্যাসিড, হিউমিক অ্যাসিড প্রভৃতি
    বাস্তুতন্ত্রের মৌলিক অজৈব উপাদান।
  
  
    (২) জৈব উপাদানঃ মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণী, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট
    ইত্যাদি জৈব যৌগ। এগুলো
  
  
    জৈবরাসায়নিক গঠনরূপে অজীব ও সজীব উপাদানের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে। (৩) ভৌত
    উপাদানঃ নির্দিষ্ট অঞ্চলের জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি ও মাটি সম্পর্কিত উপাদান নিয়ে
    গঠিত।
  
  
    (ক) জলবায়ু (Climatic factors): এতে আলো, তাপ, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা ও
    আবহাওয়া অন্তর্ভুক্ত। খ) ভূ-প্রকৃতি (Topographic factors): এতে নির্দিষ্ট
    জায়গার অক্ষাংশ, পর্বতমালা ও উপত্যকার দিক, ঢাল বা খাড়া অবস্থা প্রভৃতি
    অন্তর্ভুক্ত।
  
  
    (গ) মাটি সম্পর্কিত উপাদান (Edaphic factors): এতে নির্দিষ্ট জায়গার
    মাটির গঠন, এর ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ এবং এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিষয়
    অন্তর্ভুক্ত।
  
  সজীব উপাদান
    এতে নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্রে উপস্থিত যাবতীয় সজীব বস্তু, যেমন-প্রাণী, উদ্ভিদ,
    অণুজীব প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। সজীব উপাদান তিন রকম, যথা- উৎপাদক, খাদক এবং
    বিয়োজক ও পরিবর্তক বা রূপান্তরক।
  
  
    (১) উৎপাদক (Producer): এরা বাস্তুতন্ত্রের স্বভোজী জীব অর্থাৎ সবুজ
    গাছপালা যারা সৌরশক্তিকে সংবন্ধন ও সরল অজৈব পদার্থের সমন্বয়ে খাদ্যরূপে জটিল
    জৈব যৌগ সংশ্লেষ করে। ক্ষুদ্র ও আণুবীক্ষণিক ফাইটোপ্ল্যাংকটন, শৈবাল ইত্যাদি
    থেকে শুরু করে পানিতে ভাসমান উদ্ভিদ বা ছোট-বড় স্থল উদ্ভিদ সবাই উৎপাদক।
  
  
    (২) খাদক (Consumer): বাস্তুতন্ত্রে যে সব জীব উৎপাদকের তৈরি খাদ্যের
    উপর নির্ভরশীল, তাদের খাদক বলে। এরা বাস্তুতন্ত্রের প্রাণী সদস্য এবং
    ম্যাক্রোখাদক (macroconsumer) নামেও পরিচিত।
  
  
    একটি বাস্তুতন্ত্রে প্রধানত তিন শ্রেণীর খাদক পাওয়া যায়। এরা হচ্ছেঃ
  
  
    (ক) প্রাইমারী খাদক (Primary consumer): যে সব জীব খাদ্যের জন্য
    সম্পূর্ণভাবে উৎপাদকের উপর নির্ভরশীল, তাদের প্রাইমারী খাদক বলে। শাকাশী
    প্রাণীরা প্রাইমারী খাদক। বনের পতজ্ঞা, হরিণ, খরগোশ, পুকুরের শাকাশী
    আর্থ্রোপোড, স্বলের গরু, ছাগল প্রভৃতি প্রাইমারী খাদক।
  
  
    (খ) সেকেন্ডেরী খাদক (Secondary consumer): যে সব খাদক প্রাইমারী
    খাদকদের খেয়ে জীবনধারণ করে, তাদের সেকেন্ডারী খাদক বলে। এরা মাংসাশী প্রাণী।
    বনের শাকাশী পতঙ্গ প্রাইমারী খাদক কিন্তু এদের খাদক ব্যাঙ বা পতঙ্গভুক পাখি
    হচ্ছে সেকেন্ডারী খাদক।
  
  
    (গ) তৃতীয় বা টারসিয়ারী খাদক (Tertiary consumer): যে সব খাদক প্রধানত
    সেকেন্ডারী খাদকদের খেয়ে জীবধারণ করে, তাদের তৃতীয় বা টারসিয়ারী খাদক বলে।
    যেমন- সাপ। সাপ সেকেন্ডারী খাদকরূপী ব্যাঙকে ধরে যায়। কিন্তু সাপকে যখন বাজপাখি
    ধরে খায়, তখন আরেক খাদক আবির্ভূত হয়। বাজ পাখিকে তখন সর্বোচ্চ খাদক বলে। তবে
    সাপ অঞ্চল ভেদে সর্বোচ্চ খাদক। যেখানে বাজপাখি নেই সেখানে সাপ সর্বোচ্চ খাদক,
    কিন্তু যেখানে বাজপাখি আছে সেখানে সাপ তৃতীয় বা টারসিয়ারী খাদক।
  
  
    (৩) বিয়োজক (Decomposer): যে সঙ্গীর উপাদান কোনো বাস্তুতন্ত্রে মৃত
    জীবের কলাভুক্ত জটিল জৈব যৌগিগুলোকে বিশ্লিষ্ট বা বিয়োজিত করে তা থেকে কিছু অংশ
    নিজেরা শোষণ করে এবং বাকি অংশের জটিল যৌগগুলোকে ভেঙে সরল জৈব যৌগে পরিণত করে
    পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়, তাকে বিয়োজক বলে। এভাবে উৎপন্ন সরল উপাদানগুলোকে উৎপাদকেরা
    কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে আবার খাদ্য উৎপাদন করে। বিয়োজকদের অণুখাদক বা
    মাইক্রোকনজিউমার (microconsumer)-ও বলে। প্রধানত মৃতজীবী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া
    বিয়োজকের ভূমিকা পালন করে। বিয়োজকরা যখন সরল জৈব যৌগ উৎপন্ন করে তখন কিছু
    অণুজীব সেগুলোকে আরও ভেঙে অজৈব যৌগে বা মৌলিক উপাদানে পরিবর্তিত করে যা
    উৎপাদকের সরাসরি গ্রহণযোগ্য হয়। এদের পরিবর্তক বা রূপান্তরক বলে। একটি
    বাস্তুতন্ত্রে উপরে বর্ণিত সবকটি উপাদানই থাকতে হবে এমন নয়। কখনও কখনও উল্লিখিত
    উপাদানগুলোর মধ্য থেকে একটি উপাদান হয়তো নাও থাকতে পারে।
  
  বাস্তুতন্ত্রের গঠন ও কার্যাবলী
    বাস্তুতন্ত্র প্রকৃতির কোনো এক নির্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপ, আদান-প্রদান ও একাত্মতার
    মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে। এ কারণেই সমুদ্র, নদী, পুকুর, অরণ্য, মরুভূমি প্রভৃতি
    নির্দিষ্ট জায়গায় কেবল নির্দিষ্ট ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়।
    অর্থাৎ একেকটি বাস্তুতন্ত্রে উপাদানগুলোর সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া, একেক রকম হয়ে
    থাকে। অতএব, বলা হয় যে, জীবমন্ডলের যে স্বানিক বা গাঠনিক ও কার্যিক একক সজীব ও
    অজীব উপাদান নিয়ে গঠিত এবং যাদের মিথস্ক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত নির্দিষ্ট পদার্থের
    নিয়মিত বিনিময় ও শক্তিপ্রবাহ ঘটে, তাকে বাস্তুতন্ত্র বলে।
  
    কোনো জীবের জীবনে পরিবেশের প্রতিক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে
    বাস্তুতান্ত্রিক উপাদানগুলোর মিথস্ক্রিয়া। স্বাভাবিক অবস্থায় জীবের উপর কোনো
    নির্দিষ্ট উপাদান নয়, বরং বাস্তুতান্ত্রিক সবগুলো উপাদানেরই প্রভাব পড়ে। সবকটি
    উপাদান আন্তঃসম্পর্কিত। একটিতে পরিবর্তন হলে অন্যগুলোতে তার প্রভাব পড়বে। যেমন-
    তাপমাত্রা বেশি হলে আর্দ্রতা অবশ্যই কমে যাবে। বেশি আলো সালোকসংশ্লেষণের হারকেই
    শুধু নয় বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতাকেও প্রভাবিত করবে। এভাবে, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে
    জীবের উপর যে প্রাভাব পড়ে তা হলো আন্তঃসম্পর্কিত উপাদানগুলোরই সম্মিলিত প্রভাব।
    সে কারণে জীবের জীবনযাত্রায় কোন্ উপাদানটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখে তা খুঁজে
    বের করা দুরূহ।
  
    কোনো নির্দিষ্ট জায়গার স্বভোজী উদ্ভিদেরা পানি, কার্বন ডাই-অক্সাইড, খনিজ
    পদার্থ, সূর্যালোক প্রভৃতি অজীব উপাদান পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে নিজেদের পুষ্টি
    সাধন করে। ঐ নির্দিষ্ট জায়গার প্রাণিগুলো পুষ্টি সাধনের জন্য প্রত্যক্ষ বা
    পরোক্ষভাবে সবুজ উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। জীবের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) মৃত্যু হলে
    মরদেহ নানান অণুজীবের ক্রিয়ায় বিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন জৈব ও অজৈব যৌগিক পদার্থে
    পরিণত হয়। এগুলো জৈব ভূ-রাসায়নিক চক্রের মাধ্যমে মৌলিক উপাদানে পরিণত হয়। এগুলো
    পরে উৎপাদক স্বভোজী উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির সময় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
    এভাবে, পরিবেশ থেকে সংগৃহীত অজীব উপাদানের পুনঃপূরণ ঘটে এবং নির্দিষ্ট জায়গার
    অজীব ও সজীব পরিবেশের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া বজায় থাকে।
  
 
Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url