ব্লকচেইন প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য কি-ব্লকচেইন প্রযুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য কি

ব্লকচেইন প্রযুক্তি বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে আমাদের জন্য ডেটা সংরক্ষণ, ডেটা শেয়ার এবং ডেটা সুরক্ষিত করার পদ্ধতিকে বদলে দিয়েছে। ব্লকচেইনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে আর্থিক লেনদেন এবং সাপ্লাই চেইন ট্র্যাকিং থেকে শুরু করে ডিজিটাল পরিচয় এবং ভোটদান ব্যবস্থা পর্যন্ত এটিকে ২১ শতকের সবচেয়ে বিপ্লবী উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে একটি করে তুলেছে। এই আর্টিকেলে, আমরা ব্লকচেইন প্রযুক্তির মূল এবং অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করব, এছাড়াও স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং সুরক্ষার জন্য কেন ব্লকচেইন শিল্প জুড়ে বিশ্বস্ত।

আর্টিকেলে যা জানবেন- ব্লকচেইন প্রযুক্তির মূল ও অন্যতম বৈশিষ্ট্য কি

ব্লকচেইনের মূল বৈশিষ্ট্য
ব্লকচেইনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য
ব্লকচেইন বৈশিষ্ট্যের উপর তৈরিকৃত অ্যাপ্লিকেশন
ব্লকচেইনের চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যত
উপসংহার

ব্লকচেইনের মূল বৈশিষ্ট্য

ব্লকচেইনকে একটি শেয়ার্ড ডিজিটাল নোটবুক হিসেবে চিন্তা করতে পারেন, যাকে সবাই বিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু কেউ গোপনে এডিট/সম্পাদনা করতে পারে না। সর্বপ্রথম, বিটকয়েনের মাধ্যমে ব্লকচেইন জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ব্লকচেইন, স্মার্ট কন্ট্রাক্ট এবং NFT থেকে শুরু করে ডিজিটাল আইডেনটিটি এবং লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত হাজার হাজার ব্যবহারের ক্ষেত্রেকে সাপোর্ট করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে, ব্লকচেইন যেকোন পরিস্থিতিতে বিশ্বাস, স্বচ্ছতা এবং সততার প্রমান রাখতে পারে। নিম্নে ব্লকচেইনের ৪টি মূল বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো।

ডিসেন্ট্রালাইজেশন (Decentralization)

ব্লকচেইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ডিসেন্ট্রালাইজেশন বা বিকেন্দ্রীকরণ।ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি ডিসেন্ট্রালাইজড সিস্টেম, যার অর্থ হলো এর নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণকারী কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বা মালিক নেই। সাধারণত, ব্যাংক বা সরকার কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের গতানুগতিক সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, ব্লকচেইন নেটওয়ার্কটি বিপুল সংখ্যক নোড দিয়ে তৈরি যা লেনদেন ভেরিফাই এবং ভেলিডেট করার জন্য একসাথে কাজ করে।

এছাড়াও, ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে প্রতিটি নোডে লেজারের একই কপি সংরক্ষিত থাকে ফলে এটি নিশ্চিত করা যায় যে কোনও একক ব্যক্তি, সত্তা বা কতৃপক্ষ সিস্টেমটিকে নিয়ন্ত্রণ করে না। এই বিকেন্দ্রীভূত ফিচারটি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে, দুর্নীতি হ্রাস করে এবং মাঝের কতৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা দূর করে - লেনদেনকে দ্রুত এবং আরও সাশ্রয়ী করে তোলে।

ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে বিকেন্দ্রীকরণ সিস্টেমের সুবিধাঃ

  • যেহেতু ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক মানুষের গণনার উপর নির্ভরশীল নয়, সেহেতু, এটি সম্পূর্ণরূপে সুসংগঠিত এবং ত্রুটি-সহনশীল।
  • ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের বিকেন্দ্রীভূত ফিচারের কারণে এই নেটওয়ার্কের ব্যর্থতার সম্ভাবনা কম। যেহেতু, হ্যাকারদের জন্য ব্লকচেইন সিস্টেম আক্রমণ করা বেশি ব্যয়বহুল, তাই এই ডিসেন্ট্রালাইজড সিস্টেম ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
  • বিকেন্দ্রীকরণ সিস্টেমে থার্ড-পার্টি জড়িত থাকে না, তাই সিস্টেমে কোনও অতিরিক্ত ঝুঁকি থাকে না।
  • ব্লকচেইনের বিকেন্দ্রীভূত বৈশিষ্ট্যটি নেটওয়ার্কের প্রতিটি অংশগ্রহণকারী বা ব্যবহারকারীর জন্য একটি স্বচ্ছ প্রোফাইল তৈরি করতে সহায়তা করে। ফলে, প্রতিটি পরিবর্তন ট্র্যাক করা যায় এবং এটি আরও সুসংহত হয়।
  • বিকেন্দ্রীভূত ফিচারের কারণে ব্যবহারকারীদের তাদের সম্পত্তির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তাদের অ্যাসেট রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য থার্ড-পার্টির উপর নির্ভর করতে হয় না।
  • উদাহরণঃ বিটকয়েন বা ইথেরিয়ামের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি নেটওয়ার্কগুলোতে, ব্যবহারকারীরা কোনও ব্যাংক বা পেমেন্ট প্রসেসরের মাধ্যমে না গিয়েই সরাসরি ডিজিটাল সম্পদ পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে পারেন।

স্বচ্ছতা (Transparency)

লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্লকচেইন সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা প্রদান করে। ব্লকচেইন লেজারটি সর্বজনীন এবং স্বচ্ছ। কারণ প্রতিটি লেনদেন একটি পাবলিক লেজারে রেকর্ড করা হয় ফলে, যে কেউ নেটওয়ার্কে অ্যাক্সেস করতে এবং দেখতে পারে। প্রতিটি ব্লকে একটি টাইমস্ট্যাম্প এবং লেনদেনের বিবরণ জমা থাকে যেগুলো কোনও চিহ্ন না রেখে পরিবর্তন করা যায় না। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে ব্যবহারকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়, কারণ এটি লেনদেনের সম্পূর্ণ দৃশ্যমানতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং জালিয়াতি বা কারসাজি এবং দুর্নীতি ঝুঁকি হ্রাস করে।
ব্যবহারের ধরণঃ
সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায়, কোম্পানিগুলো পণ্যের উৎপত্তিস্থল থেকে ফাইনাল গন্তব্যস্থল পর্যন্ত পণ্যকে ট্র্যাক করতে পারে, যা সত্যতা এবং নীতিগতো সোর্স নিশ্চিত করে।

অপরিবর্তনীয়তা (Immutability)

Immutability-এর অর্থ হলো ব্লকচেইন একটি স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় নেটওয়ার্ক। ব্লকচেইন প্রযুক্তি সমষ্টিগত নোডের মাধ্যমে কাজ করে। ব্লকচেইনের মাধ্রমে লেনদেনগুলো একবার রেকর্ড করা হয়ে গেলে, তা পরিবর্তন করা বা মুছে ফেলা যায় না। ব্লকচেইনের এই বৈশিষ্ট্যকে অপরিবর্তনীয়তা বা (Immutability) বলা হয়। ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশিংয়ের মাধ্যমে Immutability অর্জন করা হয়।

অপরিবর্তনীয়তা বা (Immutability) বৈশিষ্ট্যটি ব্লকচেইনকে একটি অপরিবর্তনীয় এবং টেম্পার-প্রুফ লেজারে পরিণত করে যা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা এবং বিশ্বাস প্রদান করে। এই বৈশিষ্ট্যটি ডেটা বা তথ্যের অখণ্ডতা নিশ্চিত করে। যেসকল অ্যাপ্লিকেশনের স্থায়ী এবং যাচাইযোগ্য তথ্য রেকর্ড করা প্রয়োজন যেমন- মেডিকেল রেকর্ড, ভূমি রেজিস্ট্রি বা আইনি চুক্তি ইত্যাদি তাদের জন্য এই বৈশিষ্ট্যটি ব্লকচেইনকে আদর্শে পরিনত করে।

যেভাবে অপরিবর্তনীয়তা তৈরী হয়ঃ

  • নেটওয়ার্কের প্রতিটি নোডে ডিজিটাল লেজারের একটি কপি থাকে।
  • ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে লেনদেন যোগ করার পূর্বে প্রতিটি নোড লেনদেনের বৈধতা পরীক্ষা করে।
  • যদি বেশিরভাগ নোড মনে করে যে এটি একটি বৈধ লেনদেন, তাহলেই শুধুমাত্র লেনদেনটি নেটওয়ার্কে যোগ করা হয়। যার মানে হলো, অধিকাংশ নোডের অনুমোদন ছাড়া কেউ কোনও ট্রানজেকশন ব্লক লেজারে যোগ করতে পারবে না।
  • কোন বৈধ ডাটা একবার রেকর্ড করা হয়ে গেলে আর পরিবর্তন করা যায় না। যার অর্থ হলো নেটওয়ার্কের কোনও ব্যবহারকারী এটি এডিট, পরিবর্তন বা মুছে ফেলতে পারবে না।

নিরাপত্তা (Security)

ব্লকচেইন ডেটা এবং ট্রানজেকশন সুরক্ষিত করার জন্য উন্নত ক্রিপ্টোগ্রাফিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। প্রতিটি ট্রানজেকশন ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার আগে একটি ঐক্যমত্য প্রক্রিয়ার (Consensus Mechanism) মাধ্যমে একাধিক নোড দ্বারা যাচাই এবং অনুমোদিত হতে হয়। ব্লকচেইনের সকল রেকর্ড আলাদ আলাদা ভাবে এনক্রিপ্ট করা হয়। ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে এনক্রিপশন সিস্টেম ব্যবহার করায় পুরো নেটওয়ার্ক জুড়ে একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তার লেয়ার বা স্তর যুক্ত হয়।

যেহেতু ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই, তাই যে কেউ নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে ডেটা যোগ, আপডেট বা মুছে ফেলতে পারে না। যেহেতু ব্লকচেইন টেকনোলজিতে উন্নত ক্রিপ্টোগ্রাফিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয় সেহেতু নেটওয়ার্কে প্রতিটি তথ্যের একটি ইউনিক আইডেনটিটি বা পরিচয় থাকে। সকল ব্লকে তাদের নিজস্ব একটি ইউনিক হ্যাশ এবং পূর্ববর্তী ব্লকের হ্যাশ থাকে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে, প্রতিটি ব্লক একে অপরের সাথে ক্রিপ্টোগ্রাফিকভাবে সংযুক্ত থাকে।

ব্লকচেইনের কোন ডেটা পরিবর্তন করতে হলে সকল ব্লকের ইউনিক হ্যাশ আইডি গুলোকে পরিবর্তন করতে হবে যা প্রায় অসম্ভব। উপরন্তু, প্রাইভেট ও পাবলিত ‘কী’ (keys) গুলো ইউজারের পরিচয় এবং ডিজিটাল অ্যাসেটকে অননুমোদিত অ্যাক্সেস থেকে রক্ষা করে। বিকেন্দ্রীকরণ, এনক্রিপশন এবং ঐক্যমত্য (Consensus)-এর সংমিশ্রণের কারণে বর্তমানে যত নিরাপদ ডিজিটাল সিস্টেম রয়েছে তাদের মধ্যে শির্ষে রয়েছে।
উদাহরণঃ আর্থিক খাতে, ব্যবহারকারীর ডেটা এনক্রিপ্ট করায় ব্লকচেইন হ্যাকিং এবং পরিচয় চুরির ঝুঁকি কম থাকে। কারণ, সমস্ত ডেটা একটি একক ডাটাবেসে স্টোর করার পরিবর্তে একাধিক নোডে সংরক্ষণ করা হয়।

ব্লকচেইনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য

ব্লকচেইনের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি বৈশিষ্ট্য ছাড়াও বেশ কিছু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার কারণে ব্লকচেইন সকলের কাছে রিলায়েবল এবং ট্রান্সপারেন্ট। নিম্নে ব্লকচেইনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আলোচরা করা হলো।

ঐক্যমত্য প্রক্রিয়া (Consensus Mechanisms)

Consensus Mechanisms হলো একটি প্রোটোকল। এর মাধ্যমে সকল অংশগ্রহণকারী লেনদেনের বৈধতার বিষয়ে একমত হয়েছে তা নিশ্চিত করে। প্রতিটি ব্লকচেইনের একটি ঐক্যমত্য (Consensus) রয়েছে যা নেটওয়ার্ককে দ্রুত এবং নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে সাহায্য করে। Consensus হলো নেটওয়ার্কে সক্রিয় নোডের গ্রুপের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি অ্যালগরিদম। যা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সিস্টেমের সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।

নোডগুলো একে অপরকে বিশ্বাস নাও করতে পারে কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নেটওয়ার্কের মূল অংশে চলমান অ্যালগরিদমকে বিশ্বাস করতে পারে। ইন্টরনেটে অনেক Consensus Mechanisms অ্যালগরিদম পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি অ্যালগরিদমের সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। প্রতিটি ব্লকচেইনের অবশ্যই একটি ঐক্যমত্য প্রক্রিয়া (Consensus Mechanisms) অ্যালগরিদম থাকা উচিত, অন্যথায় এটি তার মূল্য হারাবে। সাধারণ মেকানিজম গুলোর মধ্যে রয়েছে কাজের Proof of Work (PoW), Proof of Stake (PoS), এবং Delegated Proof of Stake (DPoS)।

এই মেকানিজম গুলো ব্লকচেইনের নির্ভরযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার পাশাপাশি, ক্ষতিকারক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করে এবং সকল নোড লেজারের অভিন্ন বা একই কপি সংরক্ষণ করে তা নিশ্চিত করে। কিছু নোড ব্যর্থ হলে বা উল্টা পাল্টা কাজ করলেও, কনসেনসাস মেকানিজম ব্লকচেইনকে তার অখণ্ডতা এবং ত্রুটি সহনশীলতা প্রদান করে।

ট্রেসেবিলিটি

ব্লকচেইনের আরেকটি শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য হলো এর ট্রেসেবিলিটি ক্ষমতা। যেহেতু প্রতিটি লেনদেন কালানুক্রমিকভাবে এবং সর্বজনীনভাবে রেকর্ড করা হয়, তাই কোনও অ্যাসেট বা পণ্যের হিস্ট্রি ট্রেস করা সহজ। এই বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে লজিস্টিকস, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ফুড সাপ্লাই চেইনের মতো শিল্পগুলোর জন্য খুব উপযুক্ত, যেখানে সত্যতা এবং সোর্স ট্র্যাকিং অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, খামার থেকে খাবারের টেবিল পর্যন্ত জাল পণ্য হ্রাস এবং ভোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্লকচেইন কোনও খাদ্য পণ্যের উৎপত্তি ট্র্যাক করতে সাহায্য করতে পারে।

স্মার্ট কন্ট্রাক্ট

স্মার্ট কন্ট্রাক্ট হলো কোডের মাধ্যমে লেখা পূর্বনির্ধারিত নিয়ম এবং শর্তাবলী যা নিজে নিজে সম্পাদন হতে পারে। মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়াই পূর্বনির্ধারিত নিয়ম এবং শর্তাবলী পূরণ হওয়া মাত্রই কন্ট্রাক্ট গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়। স্মার্ট কন্ট্রাক্ট গুলো কাগজপত্র নিয়ে কাজ কমিয়েছে মধ্যস্থতাকারীদের নির্মূল করেছে এবং দ্রুত ও আরও সঠিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, রিয়েল এস্টেটে, স্মার্ট কন্ট্রাক্ট এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পত্তি বিক্রয় করা যেতে পারে। পেমেন্ট ভেরিফাই হয়ে গেলে মালিকানা হস্তান্তর করা হয়ে যাবে, এক্ষেত্র দালাল বা আইনজীবীর প্রয়োজন হবেনা।

অটোমেশন

ব্লকচেইনের অটোমেশন ক্ষমতা স্মার্ট কন্ট্রাক্ট কেউ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এইটি স্বয়ংক্রিয় কর্মপ্রবাহকে ব্যাপকভাবে সক্ষম করেছে। যেমন- ভেরিফিকেশন, ট্রানজেকশন, রেকর্ড সংরক্ষণ করা ইত্যাদি কাজ করার জন্য মানুষের প্রয়োজন হয় না। নিরাপদ এবং স্বচ্ছ পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি অটোমেশন, মানুষের ত্রুটি কমিয়েছে, কাজের গতি বাড়িয়েছে এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে।

টোকেনাইজেশন

ব্লকচেইনের মাধ্যমে টোকেনাইজেশন করা সম্ভব হয়েছে। ব্লকচেইন ব্যবহার করে বাস্তব বা ফিজিক্যাল অ্যাসেট যেমন- শিল্প, রিয়েল এস্টেট বা স্টক কে ডিজিটাল টোকেনে রূপান্তর করা যায়। ব্লকচেইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে এই টোকেনগুলো সহজ ও নিরাপদে লেনদেন করা যায়। টোকেনাইজেশন নতুন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে, লিকুইডটি বৃদ্ধি  করেছে। পূর্বে বড় বিনিয়োগকারীদের লিমিটেড সম্পদের অ্যাক্সেসকে ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমানে বড় বড় বিনিয়োগকারীরা ব্লকচেইনের টোকেনাইজেশন এর উপর বিনিয়োগ করছেন। উদাহরণঃ রিয়েল এস্টেটের একটি অংশকে ডিজিটাল টোকেনে ভাগ করা যেতে পারে, ফলে একাধিক বিনিয়োগকারী ছোট বা বড় শেয়ারের মালিক হতে পারেন।

উচ্চ প্রাপ্যতা (High Availability)

যেহেতু ব্লকচেইন একটি বিতরণকৃত/ডিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্কে কাজ করে, সেহেতু এটি খুব সহজে পাওয়া যায় এবং এটি ব্যর্থতা প্রতিরোধী। যদি কিছু নোড অফলাইনে চলে যায়, তার পরেও নেটওয়ার্কটি বাধাহীনভাবে কাজ করতে থাকে। এই বৈশিষ্ট্যটি এটাই নিশ্চিত করে যে, ব্লকচেইন সিস্টেমগুলো সবসময় কার্যকর থাকে এবং কেন্দ্রীয় সিস্টেমের তুলনায় ডাউনটাইমের হার খুব কম। উদাহরণঃ গ্লোবাল পেমেন্ট সিস্টেমে, ব্লকচেইন গতানুগতিক ব্যাংকিং সময় বা আঞ্চলিক বিধিনিষেধের উপর নির্ভর না করেই 24/7 লেনদেন করতে সক্ষম।

ছদ্মনাম এবং গোপনীয়তা (Pseudonymity and Privacy)

ব্লকচেইনে লেনদেন স্বচ্ছ হলেও, ইউজাররা তাদের ছদ্মনাম ব্যবহার করতে পারেন ফলে অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় সুরক্ষিত থাকে। ব্লকচেইন ব্যবহারকারীরা তাদের আসল নাম বা ব্যক্তিগত বিবরণের পরিবর্তে ক্রিপ্টোগ্রাফিক ঠিকানা ব্যবহার করে যোগাযোগ করেন। লেনদেনের জন্য পাবলিক ভেরিফিকেশন করা হলেও গোপনীয়তা নিশ্চিত থাকে। Zcash এবং Monero-এর মতো উন্নত ব্লকচেইন সিস্টেমগুলো Zero-knowledge Proofs এবং Privacy-focused Technologies এর মাধ্যমে Anonymity (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকতা) বৃদ্ধি করে।

ডেটা ইন্টিগ্রিটি এবং অডিটেবিলিটি

ব্লকচেইনের কাঠামোর কারণে ডেটা ইন্টিগ্রিটি এবং অডিটেবিলিটি বজায় থাকে যা ব্লকচেইনকে সকলের কাছে আদর্শে পরিনত করেছে। যেহেতু, প্রতিটি ব্লকে একটি টাইমস্ট্যাম্প এবং পূর্ববর্তী ব্লকের একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক রেফারেন্স থাকে, ফলে রেকর্ডের একটি টেকসই চেইন তৈরি হয়। এই কালানুক্রমিক ক্রম অডিটিংকে সহজ এবং দক্ষ করে তোলে। সম্মতি এবং প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সঠিক এবং টেম্পার-প্রুফ রেকর্ড বজায় রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্লকচেইনের উপর নির্ভর করতে পারে।

লেনদেনের খরচ কমানো

ট্রাডিশনাল ফিনানসিয়াল সিস্টেমে মধ্যস্থতাকারীরা লেনদেন প্রসেসিংয়ের জন্য উচ্চ ফি নিতে পারে।ব্লকচেইনে যেহেতু মধ্যস্থতাকারী বা কেন্দ্রীয় সংস্থা নেই তাই লেনদেনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কম।স্মার্ট কন্ট্রাক্ট এবং পিয়ার-টু-পিয়ার সিস্টেম লেনদেন প্রসেকে সহজতর করেছে ফলে প্রশাসনিক ওভারহেড দূর হয়েছে। এই সিস্টেম ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে অর্থের দ্রুত লেনদেন ও উচ্চ মুনাফা মার্জিনের দিকে পরিচালিত করেছে।

ব্লকচেইন বৈশিষ্ট্যের উপর তৈরিকৃত অ্যাপ্লিকেশন

ব্লকচেইনের এই সকল বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণের কারণে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের সুবিধা ও স্বচ্ছতার জন্য ব্লকচেইন গ্রহণ করছে।
অর্থায়নঃ নিরাপদ এবং তাৎক্ষণিক পিয়ার-টু-পিয়ার পেমেন্ট, বিকেন্দ্রীভূত অর্থায়ন (DeFi), এবং আন্তঃসীমান্ত (cross-border) লেনদেন।
স্বাস্থ্যসেবাঃ রোগীর পূর্ণ সম্মতিতে চিকিৎসা রেকর্ডের নিরাপদ শেয়ারিং।
সাপ্লাই চেইনঃ ভেজাল পণ্য রোধ করার জন্য পণ্যের স্বচ্ছ ট্র্যাকিং।
ভোটদান ব্যবস্থাঃ টেম্পার-প্রুফ স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য ডিজিটাল ভোটিং।
শক্তিঃ উৎপাদক এবং ভোক্তাদের মধ্যে বিকেন্দ্রীকৃত শক্তি বাণিজ্য।
প্রতিটি অ্যাপ্লিকেশন ব্লকচেইনের বৈশিষ্ট্যগুলোকে কাজে লাগায়। অপরিবর্তনীয়তা এবং স্বচ্ছতা থেকে শুরু করে অটোমেশন এই ফিচারগুলোর মাধ্যমে আরও দক্ষ এবং বিশ্বস্ত সিস্টেম তৈরি করা হয়।

ব্লকচেইনের চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যত

শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও, ব্লকচেইন এখনও স্কেলেবিলিটি, উচ্চ শক্তি খরচ (PoW সিস্টেমে) এবং নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তার মতো চ্যালেঞ্জের গুলো মুখোমুখি হচ্ছে। তবে, চলমান উদ্ভাবন, যেমন- লেয়ার-২ স্কেলিং সলিউশন, গ্রীন কনসেনসাস মডেল এবং আন্তঃকার্যক্ষমতা প্রোটোকল ব্লকচেইনের দক্ষতা এবং স্থায়িত্ব আরো উন্নত করে চলেছে। যেহেতু, বিশ্বব্যাপী শিল্প প্রতিষ্ঠনগুলো স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং বিকেন্দ্রীভূত ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার ব্লকচেইনের কার্যকারীতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে তাই ব্লকচেইনের ভবিষ্যৎ আশাব্যঞ্জক দেখা যাচ্ছে।

উপসংহার

ডিজিটাল মুদ্রার জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তি শুধুমাত্র একটি প্ল্যাটফর্ম নয়; এটি একটি বৈপ্লবিক সিস্টেম যা ডিজিটাল আস্থাকে পুনরায় চিহ্নিত করে। ব্লকচেইনের মূল বৈশিষ্ট্য (decentralization, transparency, immutability, and security) গুলো নিশ্চিত করে যে ব্লকচেইনে ডেটা গুলো অথেন্টিক এবং টেম্পার করা সম্ভব নয়। স্মার্ট কন্ট্রাক্ট, টোকেনাইজেশন এবং অটোমেশনের মতো অতিরিক্ত ফিচারগুলো ব্লকচেইনের ব্যবহারকে সীমাহীন করে তুলেছে। ফিন্যান্স থেকে স্বাস্থ্যসেবা, সাপ্লাই, রিয়েল এস্টেট এবং প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। যেহেতু, প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে তাই ব্লকচেইনের বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হতে থাকবে। এমনও হতে পারে, ভবিষ্যতে এমন একটি ডিজিটাল বিশ্ব হবে যেখানে মধ্যস্থতাকারীদের দ্বারা মানুষের আস্থা তৈরী হবেনা, আস্থা তৈরী হবে কোড এবং ঐকমত্য বা কনসেনসাসের মাধ্যমে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

প্রশ্নঃ ব্লকচেইন প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তরঃ ব্লকচেইন প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বিকেন্দ্রীকরণ বা ডিসেন্ট্রালাইজেশন। এই ফিচারের জন্য কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন হয় না এবং নিয়ন্ত্রন একাধিক নোড জুড়ে ডিস্ট্রিবিউট করা হয়।
প্রশ্নঃ ব্লকচেইনে কি ধরনের চুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে?
উত্তরঃ ব্লকচেইনের স্মার্ট কন্ট্রাক্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। পূর্বনির্ধারিত নিয়ম এবং শর্তাবলী পূরণ হলেই কন্ট্রাক্ট গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়।
প্রশ্নঃ ব্লকচেইন ডেটা কি মুছে ফেলা বা পরিবর্তন করা যেতে পারে?
উত্তরঃ না। ব্লকচেইনে কোন ডেটা একবার একটি ব্লক যোগ করা হলে, এটি অপরিবর্তনীয় হয়ে যায়, অর্থাৎ এটি পরিবর্তন বা মুছে ফেলা যায় না।
প্রশ্নঃ কী ব্লকচেইন লেনদেনকে স্বচ্ছ করে তোলে ?
উত্তরঃ ব্লকচেইনে সকল লেনদেন একটি পাবলিক লেজারে রেকর্ড করা হয়। নেটওয়ার্কে অ্যাকসেস নিয়ে যে কেউ এটি দেখতে পারে যা ব্লকচেইনের দৃশ্যমানতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
প্রশ্নঃ ব্লকচেইনে টাইমস্ট্যাম্প কি?
উত্তরঃ ব্লকচেইন টাইমস্ট্যাম্প হলো ব্লকচেইনে রেকর্ড করা তারিখ এবং সময়। ব্লকচেইনে যখন কোনও লেনদেন হয় এবং তা ব্লকে যুক্ত হয় তখনকান তারিখ ও সময় ব্লকচেইনে রেকর্ড থাকে। এটি একটি ডিজিটাল টাইম সিলের মতো কাজ করে যার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কখন ডেটা কনফার্ম হয়েছিল এবং নেটওয়ার্কে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url