মুক্তা সৃষ্টির পদ্ধতি-মুক্তা শিল্পের ইতিহাস

মানব ইতিহাসের উষালগ্নে মানুষ ছিল শিকারজীবি। শিকারের উদ্দেশ্য ছিল আহার সংগ্রহ আর শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জন্তুর চামড়া পরিধান করা। এর হাজার হাজার বছর পর, প্রস্তর যুগে মানুষ শুধু বনের পশু- পাখির উপরই নির্ভর করতো না, তারা বন ও মাঠ, নদী ও সমুদ্র সমস্ত জায়গা থেকে খাবার সংগ্রহ করতো।
মুক্তা সৃষ্টির পদ্ধতি-মুক্তা শিল্পের ইতিহাস
পাথরে তৈরি হাতিয়ার ছিল সর্বক্ষণের সংগী। এদেরই উত্তরসূরীরা ধীরে ধীরে প্রাণী ও উদ্ভিদের গুরুত্ব বুঝতে শিখে যাচাই- বাছাই করে জীবজন্তু পোষা শুরু করেছিল। কোন্ কোন্ উদ্ভিদ ও প্রাণী মানবকল্যাণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে তার সূচনা ঘটে ঐ সময়ই। এভাবে, মানুষ যখন থেকে দুধ ও মাংসের জন্য বন্যপ্রাণী পালন করতে শুরু করে তখন থেকেই অর্থনৈতিক প্রাণিবিদ্যার সূচনা হয়।

সূচিপত্রঃ- মুক্তা সৃষ্টির পদ্ধতি-মুক্তা শিল্পের ইতিহাস

প্রস্তাবনা

আজ থেকে প্রায় ২৫ হাজার বছর আগের কথা। যাযাবর শিকারী মানুষ ধীরে ধীরে সুস্থির কৃষিযুগে প্রবেশ করেছে, পূর্বসূরীদের ধারণাগুলো আরও বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হয়েছে এবং সংগ্রহশালায় পোষা জীবজন্তুর সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমান সময়ের সভ্য মানুষের উত্তরণে উপকারী প্রাণিদের অবদান অবিস্মরণীয়। বিচিত্র এ প্রাণিজগত। প্রাণিজগতের বিভিন্ন সদস্যের কাছ থেকে খাদ্য ও চামড়া ছাড়াও যে চর্বি, তেল, সার, তুলির জন্য লোম, আসবাব মসৃণ করার উপাদান, আঠা, সুগন্ধি, রেশম, পালকসহ হাজারো উপাদান সংগৃহীত হয় তা অনেকেরই অজানা।
প্রকৃতিতে প্রত্যেকটি প্রাণীরই নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে। তা সত্ত্বেও, এদের অনেকেই, যেমন- স্তন্যপায়ী, পাখি, ব্যাঙ, মাছ, চিংড়ি ও পতঙ্গ বিজ্ঞানের আধুনিক যুগে আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অনেক প্রাণী যেমন মানুষের উপকার করে, অন্যদিকে, ক্ষতিকারক প্রাণীর সংখ্যাও কম নয়। চাষাবাদের বিষয়টি যতো প্রাচীন, ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড়, ইঁদুরসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক প্রাণিদের ক্ষতির প্রকৃতিও ততো প্রাচীন। ক্ষতিকারক প্রাণিদের মধ্যে পোকামাড়ের সংখ্যা ও ক্ষতির প্রকৃতি ব্যাপক। মানুষের আবির্ভাবের কয়েক কোটি বছর আগে থেকেই এরা প্রকৃতির প্রতিটি বাসযোগ্য জায়গা দখল করে নিয়েছে।

পোকা নিজেরা যেমনি ফসল নষ্ট করে, তেমনি অণুজীব বহন করে রোগের স্থানান্তর ঘটাতেও দক্ষতম প্রাণী হিসেবে পরিগণিত। আগেই বলা হয়েছে যে প্রকৃতিতে প্রত্যেকটি প্রাণী-প্রজাতিরই নির্দিষ্ট অবস্থান ও ভূমিকা রয়েছে। এ অবস্থান ও ভূমিকা পালনে বাধা দিলে তার ক্ষতিকর প্রভাব প্রকৃতিতে পড়বেই। আসলে এর ফলেই বিভিন্ন প্রাণীকে আমরা ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করতে বাধ্য হচ্ছি। মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রাণিজগতে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে অনেক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়েছে, অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং পরিবেশ হয়েছে ভারসাম্যহীন।

এক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হওয়ায় অন্য প্রজাতির সংখ্যা বেড়েছে আর বাস্তুচ্যুত প্রজাতি মানুষের খাবারে হাত বাড়িয়েছে। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আজ সারা পৃথিবীতে ক্ষতিকারক প্রাণী দমনে জৈবনিক পন্থা অবলম্মনের জোর প্রচেষ্টা ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এজন্য ইঁদুর দমনের উদ্দেশ্যে ঈগল, বাজ, পেঁচা, সাপ, গোসাপ সংরক্ষণ এবং ক্ষতিকারক পতঙ্গ দমনে পোকাভুক পাখি, সরিসৃপ, উভচর ও অন্য পোকা সংরক্ষণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

ঝিনুক ও মুক্তাচাষ

ডাঙা ও সব ধরনের পানিতে অসংখ্য প্রজাতির মলাস্ক বাস করে। এগুলো খাদ্য অলঙ্কারসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। মলাস্কের ভেতর ঝিনুক অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদেরই কিছু প্রজাতি মহামূল্যবান মুক্তা (pearl) উৎপাদন করে। সব ঝিনুকেই এবং সব সময়ই মুক্তা পাওয়া যায় না। মুক্তা এক দুর্লভ বস্তু। চীনদেশে খ্রিষ্টজন্মের ২৩০০ বছর আগেও মুক্তার পরিচিতি ছিল।
আগে পৃথিবীর সব দেশই সামুদ্রিক ঝিনুক সংগ্রহ করে মুক্তা আহরণ করা হতো, তাই মুক্তার দামও ছিল বেশি। কিন্তু এখন নানা দেশে বিশেষ করে জাপানে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ঝিনুক চাষ করে মুক্তা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এ ধারা বাংলাদেশেও চালু হয়েছে, একদিন তা আরও বিস্তৃত ও সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

মুক্তা-ঝিনুকের স্বভাব ও বাসস্থান

মুক্তা-ঝিনুক নিশ্চল প্রকৃতির। এসব ঝিনুক সমুদ্রতলের পাথরে বা বালিতে পা-এর কিছু অংশ ঢুকিয়ে বাস করে এবং প্ল্যাংকটন খেয়ে জীবনুধারণ করে। সমুদ্রের তটরেখা থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে বিস্তৃত বাসস্থানকে পার্ল বেড (pearl beট বলে। ভারতের পূর্ব-উপকূলে, পারস্য উপসাগর, মান্নার উপসাগর, অস্ট্রেলিয়ার কাছে দক্ষিণ প্রশান্ত মাহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ সংলগ্ন সমুদ্রে, মেক্সিকো উপসাগর ও ক্যালিফোর্নিয়া উপসাগরে পার্ল বেড রয়েছে।

ঝিনুকের শ্রেণীবিন্যাস

পর্ব-Mollusca
শ্রেণী-Bivalvia
বর্গ-Unionida
গোত্র-Unionidae
গণ-Lamellidens
প্রজাতি- L. marginalis

মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক

Mollusca পর্বের Bivalvia শ্রেণীভুক্ত অনেক ঝিনুক প্রজাতি মুক্তা উৎপাদন করতে পারে। এদের সাধারণভাবে মুক্তা ঝিনুক (pearl oyster) বলে। উচ্চমানের মুক্তা পাওয়া যায় Pteriidae গোত্রের Pinctada গণভুক্ত কয়েকটি প্রজাতি থেকে, যেমনঃ
(১) Pinctada vulgaris (পিংকটাডা ভালগ্যারিস),
(২) Pinctada fucata (পিংকটাডা ফ্যুকাটা),
(৩) Pinctada anomioides (পিংকটাডা অ্যানোমিওয়ডেস)
(৪) Pinctada chemnitzi (পিংকটাডা কেমনিজি)
(৫) Pinctada atropurpurea (পিংকটাডা অ্যাট্রোপারপুরিয়া)
উল্লিখিত মুক্তা-ঝিনুক ছাড়াও সমুদ্র ও মিঠাপানিবাসী অনেক ঝিনুক মুক্তা বা মুক্তার মতো বস্তু সৃষ্টি করতে পারে, যেমন- Haliotes (হ্যালিওটিস), Mytilus (মাইটিলাস)-এর প্রজাতি ও Placuna blacenta (প্ল্যাকুনা ব্লাসেন্টা)। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অনেক মিঠা পানিবাসী ঝিনুক (Lamellidens) থেকে মুক্তা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মিঠাপানির ঝিনুক থেকে প্রাপ্ত রক্তিম (pink) মুক্তা বেশ মূল্যবান।

মুক্তা সৃষ্টির পদ্ধতি

ঝিনুকের খোলক ও ম্যান্টলের মধ্যবর্তী ন্যাক্রিয়াস তরে কোনো অবাঞ্চিত বস্তু, বালুকণা বা জীবকণা, পরজীবী বা জলজ উদ্ভিদের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ কিংবা ক্ষুদ্র পতঙ্গের অনুপ্রবেশের ফলে দেহে সৃষ্ট উদ্দীপনায় ম্যান্টল-এপিথেলিয়াম থেকে নিঃসৃত পদার্থ ঐ বস্তুর চারদিকে জমা হয়ে কালান্তরে যে গোলাকার, চকচকে পদার্থের সৃষ্টি করে তাকে মুক্তা (pearl) বলে। হঠাৎ একটি বাহিক্য বস্তু খোলক ও ম্যান্টলের মধ্যবর্তী কোথাও প্রবেশ করলে ম্যান্টলে প্রদাহের সৃষ্টি হয়।
ম্যান্টল এপিথেলিয়ামের কোষগুলো তখন অনুপ্রবিষ্ট বস্তুর চারদিক ঘিরে ফেলে এবং থলির মতো গঠন তৈরি করে বস্তুটিকে ন্যাক্রিয়াস স্তরের অংশবিশেষসহ পৃথক করে ফেলে। তখন ঐ বস্তুর চারদিকে এপিথেলিয়ামের কোষ থেকে নিঃসৃত পদার্থ চক্রাকারে জমতে থাকে। প্রদাহের পরিমাণের সাথে ক্ষরণের পরিমাণ সম্পূরক অর্থাৎ প্রদাহ বেশি হলে ক্ষরণ বেশি হয়, প্রদাহ কম হলে ক্ষরণও হয় কম। কয়েক বছরের ভেতর সেটি মুক্তায় পরিণত হয়।

তখন মুক্তার অন্তঃস্ব অনুপ্রবেশকারীকে নিউক্লিয়াস এবং চারদিকের স্তরকে মুক্তামাতা (mother of pearl) বলে।অনুপ্রবেশকারী বস্তুটি যখন ম্যান্টল গহ্বরের গভীরে প্রবেশ করে এবং এপিথেলিয়াল থলিকা সৃষ্টি হয় তখন থলির উপর চাপ পড়লে মুক্তার আকার অনিয়ত হয়ে পড়ে। অনিয়ত আকারের মুক্তাকে বারাকুড বলে। তিন-চার বছরের ভেতরই মুক্তা উল্লেখযোগ্য আকৃতি প্রাপ্ত হয়। তবে সাত বছরে বেশ বড় মুক্তা পাওয়া যায়। অধুনা বিভিন্ন দেশ কৃত্রিম উপায়ে ঝিনুকদেহে পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাকে মুক্তায় পরিণত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে।

মুক্তার বর্ণ

মুক্তার নির্দিষ্ট কোনো বর্ণ নেই। মুক্তা-ঝিনুকের স্বভাব ও পরিবেশের উপর মুক্তার বর্ণ নির্ভর করে। মুক্তার বর্ণ সাধারণত সাদা, গোলাপী, ধূসর, নীল, হলুদ, সবুজ, কালো প্রভৃতি হয়। এসবের ভেতর সাদা, নীল ও কালো মুক্তার চাহিদা বেশি। মুক্তার গাত্র অমসৃণ। বিশেষ প্রক্রিয়ায় পালিশ করে মুক্তার ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো হয়, তবে সব মুক্তা সমান ঔজ্জ্বল্য ধারণ করে না। মুক্তা-গাত্রের চকচকে ভাবকে ওরিয়েন্ট (orient) বলে।

মুক্তার রাসায়নিক গঠন

মুক্তার মুখ্য উপাদান হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বনেট। নিচে মুক্তার বিভিন্ন উপাদানের নাম ও পরিমাণ উল্লেখ করা হলো:
ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO3) : ৮৮ - ৯০%, কনকিওলিন (C3OH48N2O11) : ৩.৮ - ৫.৯%, পানিঃ ২-৪%, অন্যান্য পদার্থঃ ০.১ - ০.৮%।

প্রকৃতি থেকে মুক্তা সংগ্রহ

পারস্য উপসাগর ও লোহিতসাগরে, চীন, জাপান, ভারত, শ্রীলংকা, উত্তর অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহসাগরীয় কিছু দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্র উপকূলে যে সব মুক্তা-ঝিনুক বাস করে সেগুলো থেকে মূল্যবান মুক্তা আহরিত হয়। এভাবে মুক্তা সংগ্রহে সংগ্রহকারীর তেমন লাভ হয় না, কারণ ডুবুরিরা খুব কম পরিমাণ মুক্তা-ঝিনুক সংগ্রহ করতে পারে, অন্যদিকে মুক্তা সংগ্রহে খরচও হয় বেশি। গ্রীষ্মকালে যখন সমুদ্রের পানি শান্ত ও স্বচ্ছ হয় সে সময়ের দুমাস মুক্তা-ঝিনুক সংগ্রহের প্রকৃষ্ট সময়।

মুক্তা শিল্পের ইতিহাস

জাপানে সর্বপ্রথম মুক্তা শিল্পের ধারণার সূত্রপাত ঘটে। মুক্তা উৎপাদনের জন্য তখন জাপান সাগরে হানসুর দক্ষিণ উপকূলকে বেছে নেয়া হয়। কিন্তু দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মুক্তাচাষীরা বেশ বিপদে পড়ে যান। জাপানের Kokichi Mikimoto (ককিচি মিকিমটো, ১৮৫৪ ১৯৫৪)-কে মুক্তা শিল্পের স্থপতি বলে অভিহিত করা হয়। ১৮৯০ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত শিল্পমেলায় চড়া দামে মুক্তা বিক্রি হচ্ছে দেখে Mikimoto এক ছোট দ্বীপে মুক্তা-ঝিনুক। চাষের উদ্যোগ নেন।
দুবছর ব্যর্থ হলেন। তৃতীয় বছরে জোয়ারে তাঁর খামারের পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেল, কিছু ঝিনুক বেঁচে গিয়েছিল। ১৮৯৩ সালের ১১ই জুলাই তাঁর স্ত্রী Uma একটি মুক্তা-ঝিনুক খুলে ওর ভেতর মুক্তা দেখে আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন। দিনটি ছিল মুক্তাচাষের ইতিহাসে সস্মরণীয় দিন। ১৮৯৬ সালে Mikimoto মুক্তাচাষের কৃতিত্ব (patent) লাভ করেন। টোকিওর Misaki Marine Biological Laboratory-র বিজ্ঞানী Tokichi Nishikawa প্রথম ব্যক্তি যিনি স্ফীতকায় কৃত্রিম মুক্তা উদ্ভাবনে সফল হয়েছিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনি কি সম্মত?
প্রিয় ব্যবহারকারী, আপনারা এই ওয়েব সাইটের সকল নিয়ম, নীতিমালা এবং শর্তাবলী পড়ে এবং মেনে এই ওয়েব সাইট ব্যবহার করতে একমত কি?
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.