পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন-পরিবেশ সংরক্ষণে সামাজিক বনায়ন গুরুত্ব

আল্লাহ তা-আলা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফুল, ফল, বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দিয়ে পৃথিবীকে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও সুশোভিত করেছেন। পরিবেশ রক্ষা ও মনোরম প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণ করার জন্য আল্লাহ তা-আলা বনাঞ্চল, তৃণলতা ও বৃক্ষরাজি তৈরী করেছেন। আল্লপহর অপরূপ সৃষ্টির মধ্যে বৃক্ষরাজি অন্যতম জীব।

সূচিপত্রঃ- পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন-পরিবেশ সংরক্ষণে সামাজিক বনায়ন গুরুত্ব

ভূমিকা
বনায়ন ও পরিবেশ
পরিবেশ বিপর্যয়ে বর্তমান বিশ্ব
বাংলাদেশের বনভূমি
বাংলাদেশে বনায়নের গুরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
পরিবেশ রক্ষায় বনায়ন
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি
উপসংহার

ভূমিকা

পৃথিবীতে মানুষ না থাকলে বৃক্ষরাজির কোন প্রকার সমস্যা হবে না। কিন্তু মানুষসহ অন্যান্য প্রাণিকুল জীবন-জীবিকার জন্য বৃক্ষরাজির উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীতে গাছপালা না থাকলে আদম সন্তানের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে পড়ত। এই মর্মে আল্লাহ তা-আলা ঘোষণা করেছেন, “আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে এবং তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদ্গত করেছি নয়নপ্রীতিকর সব ধরনের উদ্ভিদ। আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি এবং এর দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি এবং সমুন্নত খেজুরগাছ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ।” (সূরা কাফ, আয়াত: ৭-১১)

“অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান। প্রাণের প্রথম জাগরণে তুমি, বৃক্ষ, আদিপ্রাণ। ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা, ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ পরে আনিলে বেদনা নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।” সভ্যতার আদি যুগে মানুষ একদিন অরণ্য প্রকৃতির নিবিড় ছায়ায় সহস্র বিটপীর স্নিগ্ধ সান্নিধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছে। কিন্তু সভ্যতা যতই সম্প্রসারিত হয়েছে, মানুষ ততই প্রকৃতির জগৎ থেকে নির্বাসিত হয়েছে। মানুষ নিজ হাতে নির্মূল করেছে তার শৈশব সভ্যতার সঙ্গী তরুরাজিকে। সভ্যতা যেমন আমাদের প্রচুর দিয়েছে, তেমনি কেড়েও নিয়েছে অনেক কিছু। বৃক্ষের সঙ্গে আমরা আজ আত্মীয়তা হারিয়ে ফেলতে চলেছি অথচ এই বৃক্ষই আমাদের প্রাণের উৎস। বৃক্ষরোপণ তথা বনায়ন শুধু প্রকৃতিকে ভালোবাসার স্মারক নয়, এ হলো মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার এক মহৎ প্রয়াস।

বনায়ন ও পরিবেশ

সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ গাছপালা ও তৃণলতার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। এ বৃক্ষলতাই মানুষের খাদ্য, বস্তু ও বাসস্থান জুগিয়েছে। জীবন ও প্রকৃতির অস্তিত্ব টিকে আছে বৃক্ষের ওপর। আগে এই বৃক্ষরাজি মানুষকে প্রাকৃতিকভাবেই বেষ্টন করে রাখত কিন্তু বৃক্ষনিধন করে আজ পৃথিবী এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষকেই বৃক্ষরোপণ করতে হচ্ছে। আর এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় বনায়ন। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে বর্তমানে এর কোনো বিকল্প নেই। বনায়ন আর সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ দুটি শব্দ যেন পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বনায়ন ছাড়া পরিবেশের অস্তিত্ব ও সৌন্দর্য কল্পনাই করা যায় না।

পরিবেশ বিপর্যয়ে বর্তমান বিশ্ব

বর্তমান সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কলকারখানার প্রসার, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তা ও বনজ সম্পদ নিঃশেষ করার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ পরিবেশ বিপর্যয়কে বিজ্ঞানীগণ গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া নামে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রতিক্রিয়ার দরুণ সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলো সরাসরি পৃথিবীতে আসছে। যার ফলে অকাল বন্যা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, তুষারপাত, ভূমিধস, প্রভৃতির মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধকল্পে যে সমস্ত কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন তাদের মধ্যে বনায়ন অন্যতম। আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন যে, পানি এবং বায়ুমন্ডলের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সম্পর্ক রয়েছে যাকে ইকোসিস্টেম বলে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে শুধু প্রকৃতি নয়, গোটা পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আর বর্তমান বিশ্ব সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই শিকার।

বাংলাদেশের বনভূমি

আমাদের দেশে একসময় যথেষ্ট বন-বনানী ছিল। কিন্তু কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিক জনসংখ্যার চাপে এবং বসতবাড়ি তৈরির প্রয়োজনে বন কাটা হচ্ছে। ফলে বর্তমানে আমাদের দেশের প্রয়োজনের তুলনায় যে পরিমাণ বনভূমি থাকা প্রয়োজন তা নেই। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে আমাদের দেশে মোট ১৭ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত সুন্দরবন, ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল ও মধুপুরের গড়, চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বনভূমি আমাদের দেশের এক বিশাল সম্পদ। তবে বর্তমানে আমাদের যে পরিমাণ বনভূমি রয়েছে তা যদি আর ধ্বংস না করা হয়, তবে তা প্রয়োজনীয় বনভূমিতে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

বাংলাদেশে বনায়নের গুরত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

মানুষ আজ অরণ্য বিনাশের মাধ্যমে পৃথিবীতে আহ্বান করে আনছে মরুভূমি। অরণ্যই মরুভূমিকে প্রতিরোধ করতে পারে, অরণ্যই মরুভূমিকে শ্যামল-স্নিগ্ধ, স্নেহময়ী জননীর মূর্তি দান- করতে পারে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নাগরিক সভ্যতার ইট, কাঠ, পাথরের কৃত্রিমতায় ক্লান্ত হয়ে আবেগ কম্পিত কণ্ঠে প্রার্থনা করেন-
“দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর
নাও যত লৌহ, লোষ্ট্র, কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নব সভ্যতা, হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী দাও ফিরে তপোবন, পুণ্যচ্ছায়া রাশি।”
উন্নয়নশীল বিশ্বের শতকরা ৩০ ভাগ ইন্টারনাল রিটার্ন ও শতকরা ৭০ ভাগ জ্বালানি শক্তির জন্য বৃক্ষ বা কাঠের ওপর নির্ভরশীল এবং এ চাহিদা পূরণের জন্য কোনো দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনজসম্পদ অত্যাবশ্যকীয়। অর্থনৈতিক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসম্পদের পরিমাণ মোট ভূ-ভাগের ৯.৩ শতাংশ এবং বন বিভাগের মতে ০.০৯ শতাংশ, যা জনবহুল বাংলাদেশের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু কাঠ ব্যবহারের পরিমাণ ২.৬৮ ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে কাঠের চাহিদার মাত্র ৪৮.৫ শতাংশ নিজস্ব বনভূমি থেকে পূরণ করা সম্ভব।

পরিবেশ রক্ষায় বনায়ন

প্রখ্যাত পরিবেশবিজ্ঞানী মাইকেল মালিকফার ইস্টার্ন রিভিউতে একটি মানচিত্রের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে আগামী শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক-দশমাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। সাম্প্রতিককালে একজন খ্যাতনামা পরিবেশ বিজ্ঞানীর ভাষ্য, ক্রমাগত বৃক্ষ নিধনের ফলে ২০৩০ সালে এ দেশের ৮০০ থেকে ১০°সে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের গড় তাপমাত্রা ৩৫০-৩৬° সে. বেড়ে ৪৫০- এ দাঁড়াবে। কাজেই আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়নের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। বাংলাদেশের নামের সাথে যে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বা রূপসি বাংলা নাম জড়িয়ে আছে সে নামটিই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যদি আমরা পরিবেশ সংরক্ষণে বা বনায়নে উদ্যোগী না হই। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে তাই বনায়নের কোনো বিকল্প আমাদের কাছে নেই।

বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি

বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন গ্রামীণ জনপদে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্রদ্র্য বিমোচনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। সেই সাথে সামাজিক বনায়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন উপশম ও অভিযোজনে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বন বিভাগ ষাটের দশকের শুরুর দিকে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বনায়ন কর্মসূচি জনগণের কাছে নিয়ে যায়। ২০০০ সালে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমকে ১৯২৭ সালের বন আইনে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আইনি কাঠামোতে নিয়ে আসে। সামাজিক বনায়নকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ২০০৪ সালে সরকার বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং ২০১০ সালে সংশোধনী আনা হয়। বন বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের আওতায় এযাবৎ প্রায় ৪৪৪০৮ হেক্টর উডলট বাগান, ১০,৬২৬ হেক্টর কৃষি বাগান, ৬১,৭৩৯ কিলোমিটার স্ট্রিপ সৃজন করা হয়েছে। এছাড়া বিগত ৪ বছরে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড আওতাভুক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি ও নন-ম্যানগ্রোভ ২১৫৫ হেক্টর ব্লক বনায়ন এবং সড়ক রেলপথ ও বাঁধ সংযোগ সড়কে ২৬৪১ কি.মি. স্ট্রিপ বনায়ন করা হয়েছে। সৃজিত বাগানে প্রায় ৫ লক্ষ উপকারভোগী সম্পৃক্ত আছে। সারাদেশে ব্যাপক বনায়নের লক্ষ্যে প্রায় ৪ কোটি ৮৮ লক্ষ ৬৩ হাজার চারা বিক্রয় ও বিতরণ করা হয়েছে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে এ পর্যন্ত সরকারি রাজস্ব হয়েছে ২০৫ কোটি ৩৭ লক্ষ ৮৪ হাজার ৮ শত ৭০ টাকা।

উপসংহার

দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য বৃক্ষরোপণ অভিযান একটি বিরাট পদক্ষেপ। বৃক্ষরোপণ অভিযান তথা বনায়ন সফল হলে দেশের হৃত গৌরবকে শস্য-শ্যামলিমার দেশ এই বাংলাকে আবার চিরসবুজ শ্যামল করা যাবে। তাই আমরা বনায়ন অভিযানের মাধ্যমে লাগাব বৃক্ষ, তাড়াব দুঃখ, দেশকে করব সমৃদ্ধ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

Timeline Treasures নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url