পরিবেশ বিপর্যয় কাকে বলে-পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ

পরিবেশ বিপর্যয় বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবী এবয় এর জীবমন্ডল আজ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। স্থলভাগ, বায়ুমন্ডল, পানি ও অন্যান্য জীবজন্তু নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের পরিবেশ। মানুষের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে এ পরিবেশ।
পরিবেশ বিপর্যয় কাকে বলে-পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ
মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দে যেন সামান্যতম ঘাটতি না হয়, ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য প্রকৃতি এতটুকুও কার্পণ্য করেনি। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিদত্ত এ উপহারকে অবহেলা করেছে, তাচ্ছিল্যভরে ভোগ করেছে, যথেচ্ছ পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

আলোচ্য বিষয়ঃ- পরিবেশ বিপর্যয় কাকে বলে-পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ

পরিবেশ যে অমূল্য সম্পদ তা আজ হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে। পৃথিবী জুড়ে এখন তাই পরিবেশের জয়গান গাওয়া হচ্ছে। পৃথিবীকে অধিকতর বাসযোগ্য করার উদ্দেশ্যে এবং মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে, পৃথিবীর স্থায়িত্ব বাড়াতে পরিবেশ সংরক্ষণ যে অপরিহার্য তা এখন সবাই একবাক্যে স্বীকার করছে।
পৃথিবীর এ বিপর্যস্ত অবস্থা কেন হলো, কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায় এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য কীভাবে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে চলছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মতবিনিময়। এ বিষয়ে জাতিসংঘের শ্লোগান হচ্ছেঃ “Only one earth, Care and Share”।

পরিবেশ বিপর্যয় কাকে বলে

পরিবেশে যে কোনো গুণগত পরিবর্তন যা জীবের জীবনধারণে প্রতিকূল ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে, তাকে পরিবেশ বিপর্যয় বলে।

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণসমূহ

বিভিন্ন কারণে মানুষের পরিবেশ আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এসব কারণকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিম্নোক্ত কয়েকটি প্রধান শিরোনামের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
(১) ভূমির অবক্ষয়, (২) পরিবেশ দূষণ, (৩) বনভূমি ধ্বংস, (৪)-তেজষ্ক্রিয়তা এবং (৫) আবহমণ্ডলের পরিবর্তন।

ভূমির অবক্ষয়

যে সব কর্মকান্ডের ফলে জমির উৎপাদন শক্তি হ্রাস পায়, মাটির সতর সরে যায় এবং বনভূমির বিনাশ ঘটে, তাকে ভূমির অবক্ষয় বলে। ভূমি অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ চাষাবাদ। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ঘন বসতি, মানুষের ব্যবহৃত জঞ্জাল, বনভূমি ধ্বংস, কৃষিজ ও শিল্পজ দূষণ, দুর্বল সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, অতিবর্ষণ, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা, জলাভূমি ভরাট, অত্যধিক পশু চারণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের নোনা পানির প্রবেশ, খনিজ আহরণ ইত্যাদি। ভূমি অবক্ষয়ের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত হয়ে যায় কিংবা মরুপ্রবণ হয়ে উঠে।
সবুজ গাছপালাবিহীন এসব অঞ্চলে সামান্য বৃষ্টিপাত, পানিধারা ও বায়ুপ্রবাহে ভূমিক্ষয় আরও ত্বরান্বিত হয়। ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি পানিবাহিত হয়ে নদীগর্ভ ভরাট করে দেয়, ফলে নদীর নাব্যতা কমে যায় এবং সামান্য বৃষ্টিতেই দুকুল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দেয়। ভূমির অবক্ষয় রোধে বসতি নির্মাণ, ভূগর্ভস্থ পানিসেচ ও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পতিত জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানো হলেও সাফল্য খুব কম। এভাবে ভূমির অবক্ষয় ঘটিয়ে মানুষ নিজের তথা পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছে।

পরিবেশ দূষণ

পানি, স্থল, অন্তরীক্ষের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবনিক বৈশিষ্ট্যের কোনো অবাঞ্চিত পরিবর্তনের ফলে যদি মানুষসহ অন্যান্য জীবের জীবনধারণ, শিল্পস্থাপনা ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের ক্ষতি হয় বা ক্ষতি হতে পারে এমন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়, তখন তাকে দূষণ বলে। দূষণ সৃষ্টিকারী উপাদানকে দূষক (pollutant) বলে।

(১) বায়ু দূষণ

স্বাভাবিক বায়ুমন্ডলে যদি এমন কোনো উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটে যার ফলে উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ বা শিল্প-কলার ক্ষতি হয় বা ক্ষতির সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়, তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে। বিভিন্ন কল-কারখানার চিমনির ধোঁয়া, যন্ত্রযানের ধোঁয়া বায়ুতে মিশে বায়ুকে দূষিত করছে। নিচে বায়ু দূষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচিত হলো।

বায়ু দূষণের উৎসঃ

বায়ু দূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানী অর্থাৎ কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস দহনের ফলে নির্গত নিম্নোক্ত কণাময় ও গ্যাসীয় পদার্থঃ
(১) সূক্ষ্ম কণা (১০০μ- এর কম ব্যাসযুক্ত), যথা-কার্বন কণা, ধাতব ধূলি, রেজিন, অ্যারোসল, কঠিন অক্সাইড, নাইট্রেট ও ফসফেটসমূহ।
(২) অমসৃণ কণা (২০০μ-এর বেশী ব্যাসযুক্ত) যথা- কার্বন কণা ও ভারী ধূলিকণা।
(৩) সালফার, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, হ্যালোজেন প্রভৃতির যৌগসমূহ।
(৪) তেজস্ক্রিয় পদার্থ।
উল্লিখিত অপ্রাকৃতিক দূষকগুলোর উৎসস্থল হচ্ছেঃ পরিবহন শিল্প, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা ও তাপযন্ত্র।
প্রকৃতিও কিছু দূষক বাতাসে যোগ করে, যেমন-রেণু, উদ্ভিদ-নির্গত হাইড্রোকার্বন, মরু ও ঝড়ের ধূলি এবং অগ্ন্যুৎপাত।

বায়ু-দূষণের ফলাফলঃ

বায়ু-দূষণ আজ পৃথিবীর ভয়াবহতম ক্ষতিকর প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। নিচে কয়েকটি ফলাফলের উল্লেখ করা হলো।
(১) বিশ্বময় উষ্ণতায়নের সৃষ্টি হয়েছে।
(২) অ্যাসিড বৃষ্টিতে কৃষি জমি, নদী-নালা ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য বিনষ্ট হচ্ছে।
(৩) নতুন নতুন জায়গায় রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে।
(৪) মানুষের প্রায় প্রত্যেকটি অজ্ঞাতন্ত্রে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
(৫) ক্যান্সার, নিউমোনিয়া, জন্ডিসসহ অন্যান্য মারাত্মক রোগের বিস্তার ঘটছে।
(৬) তেজস্ক্রিয়তার ফলে হাড়ের ক্যান্সার, লিউকোমিয়া ও মিউটেশনের প্রকোপ বাড়ে। তা ছাড়া বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ফসলের ক্ষতি হয়।
(৭) ওজোন-স্তন ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়।

(২) পানি দূষণ

হ্রদ, ঝর্ণা, নদী ও সাগরে নির্গত শিল্পজাত বা গেরস্থালীয় বর্জ্য পানিতে বিগলিত হয়ে বা ভাসমান কিংবা তলায় জমে থেকে জলজ বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে ব্যাঘাত ঘটালে, তাকে পানি দূষণ বলে।

পানি দূষণের উৎসঃ

পানি দূষণের মূল উৎস হচ্ছে শিল্প-কারখানাজাত বিষাক্ত রাসায়নিক, তেজষ্ক্রিয় পদার্থ ও উষ্ণ পানি এবং গার্হস্থ্য জৈব জঞ্জাল। এর সংগে রয়েছে ভূমিক্ষয় থেকে সৃষ্ট পলি, বৃষ্টিবাহিত সার, কীটনাশক, জাহাজ নির্গত তেল ইত্যাদি।

পানি দূষণের ফলাফলঃ

(১) অক্সিজেনের ঘাটতিতে মাছসহ অন্যান্য পানিবাসী জীবের মৃত্যু ঘটে।
(২) পানি দুর্গন্ধময় ও জীবাণুযুক্ত হয়ে মানুষে পানি-বাহিত মারাত্মক রোগের (যেমন-টাইফয়েড, আমাশয়, পোলিও, হেপাটাইটিস, বটুলিজম, স্ক্যাবিস, ট্রকোমা, সিস্টোসোমিয়াসিস প্রভৃতি) বিস্তার ঘটে।
(৩) পানি কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
(৪) খাদ্য শৃঙ্খলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে।
(৫) তলানির ফলে জলাশয়ে পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় অকাল বা দীর্ঘকালীন বন্যা দেখা দেয় ও মাছ উৎপাদন হ্রাস পায়।
(৬) তেজষ্ক্রিয় পদার্থের প্রতিক্রিয়া উদ্ভিদ-প্রাণী নির্বিশেষে অত্যন্ত মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী। এ পানি ব্যবহারে, সাঁতার কাঁটলে কিংবা তেজষ্ক্রিয়তাযুক্ত মাছ খেলে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ক্যান্সার ও জননবিকৃতিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে পার।
(৭) উষ্ণ পানির প্রভাবে সচল জীবের পরিযান ও নিশ্চল জীবের মরণ ঘটে।
(৮) তেল দূষণের ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার সামুদ্রিক পাখির মৃত্যু হয়।

(৩) মাটি / স্থল দূষণ

মাটির উপর পইড় থাকা এমনসব জিনিসপত্র যা দ্রুত বা কখনোই জৈব বা অজৈব প্রক্রিয়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়ে নির্দিষ্ট ভূমিমন্ডকে অব্যবহার্য ও অকার্যকর করে তোলে, তাকে মাটি বা স্থল দূষণ বলে।

মাটি/ স্থল দূষণের উৎসঃ

পরিত্যক্ত যানবাহন বা অন্যান্য দ্রব্য, লোহা-লক্কর, টিন ও প্লাস্টিকের সামগ্রী, চিকিৎসা বর্জ্য, পলিথিনের জিনিসপত্র, কীটনাশক, মলমূত্র ইত্যাদি স্থল দূষণের উৎস।

মাটি / স্থল দূষণের ফলাফলঃ

(১) বিস্তীর্ণ এলাকা ক্রমশ অব্যবহারযোগ্য ও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
(২) ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ চতুর্দিকে ছড়িয়ে অন্যান্য জীবের বসবাস অসম্ভব করে তোলে।
(৩) জীবাণুর বিস্তৃতি ঘটে।

বনভূমি ধ্বংস

নতুন বনভূমি সৃষ্টির ব্যবস্থা না রেখে এবং অন্য বনভূমিগুলোর সুষ্ঠু সংরক্ষণ না করে নির্বিচারে বনভূমি উজাড় করাকে বনভূমি ধ্বংস বা অরণ্য সংহার বলে। বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক দেশের জন্য তার আয়তনের অন্তত ২৫টি এলাকায় বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত গাছ কাটার মাধ্যমে বনভূমি ধ্বসে।

বনভূমি ধ্বংসের কারণঃ

বনভূমি ধ্বংসের অনেক কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে মানববসতি স্থাপন, কৃষিজমি সম্প্রসারণ, জ্বালানী, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ অবৈজ্ঞানিক বনায়ন, রোগ-ব্যাধি, ঝুম চাষ, পশু চারণ, নির্মাণ সামগ্রী আহরণ, পরিবেশ দূষণ, অভিবাসন, মরুকরণ প্রভৃতি।

বনভূমি ধ্বংসের ফলাফলঃ

বনভূমি ধ্বংসের ফলে প্রতি বছর বায়ুমন্ডলে CO₂ এর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে ফলে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে এবং খরা ও মরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে, ক্ষয়িত ভূমির কারণে নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানিচক্রসহ অন্যান্য ভূ-জৈব-রাসায়নিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটছে। বন্যপ্রাণী বিপন্ন ও বিলুপ্ত হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও ওষধী গুণসম্পন্ন গাছ হারিয়ে যাচ্ছে, এবং উপকূলে ঝড়ের তান্ডব তীব্র অনুভূত হচ্ছে। এক কথায় বলতে গেলে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র, আবহাওয়া ও মানুষের জীবনে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে চলেছে কেবল বনভূমি ধ্বংসের কারণে।

তেজস্ক্রিয়তা

সূর্যের দৃশ্যমান আলোক রশ্মি ও তাপের উৎস অবলোহিত রশ্মি ছাড়াও রয়েছে অদৃশ্য অতিবেগুনী, রঞ্জন বা এক্স, আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব রশ্মি তেজস্ক্রিয় বস্তুর অণু ও পরমাণুর মধ্যে আয়নের সৃষ্টি করে তার ভারসাম্য শিথিল করে দেয়। তেজস্ক্রিয় রশ্মি এবং আয়োনিত তেজস্ক্রিয় সাধারণভাবে তেজস্ক্রিয়তা বলে পরিচিতি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে, উদ্ভিদবিজ্ঞানে, পরমাণু শক্তি। ও অস্ত্র উৎপাদনে প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে তেজষ্ক্রিয়তার ব্যাপক ব্যবহার হয়। আয়োনিত এই তেজস্ক্রিয়া পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে।

তেজস্ক্রিয় রশ্মির উৎসঃ

তেজস্ক্রিয় রশ্মির উৎস হচ্ছে-
(ক) সূর্য, তারামন্ডল ও বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু।
(খ) তেজস্ক্রিয় পদার্থ, পরমাণু, বোমা, তেজস্ক্রিয় জ্বালানী ও বর্জ্য।
(গ) খনিজ ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, রেডিয়াম, কার্বন, পটাসিয়াম ইত্যাদি।

আবহমন্ডলের পরিবর্তন

ওজোন স্তরের ক্ষয় এবং গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া হচ্ছে আবহমন্ডলে পরিবর্তনের মূল কারণ।

ওজোন স্তরের ক্ষয়ঃ

বায়ুমন্ডলের স্ট্রটোস্ফিয়ারে ওজোন গ্যাসের (O3) যে স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির বিকীরণ ছেঁকে দেয়, তাকে ওজোন স্তর বলে। প্রাকৃতিক বিক্রিয়া ছাড়া অন্যান্য কারণে ওজোন সতরের রাসায়নিক ভাঙনকে ওজোন স্তরের ক্ষয় (ozone depletion) বলে।

ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণঃ

ওজোন স্তর ক্ষয়কারী বস্তুগুলো হচ্ছে- ক্লোরোফ্লুরোকার্বনসমূহ (CFCs), হাইড্রোক্লোরোফ্লুরোকার্বনসমূহ (HCFCs), মিথাইল ব্রোমাইড (CH3Br), কার্বন টেট্রাক্লোরাইড (CCl4), মিথাইল ক্লোরোফর্ম (CH3CCl4) এবং হ্যালোনসমূহ (Halons: ব্রোমিন, ফ্লোরিন ও কার্বনের যৌগ)। এগুলোর মধ্যে CFC সমূহ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকারক। আর এর উৎস হচ্ছে: রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, স্প্রে-জাতীয় কৌটা, জেট ইঞ্জিন, মোটর যান ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান।

ওজোন-তর ক্ষয়ের ফলাফলঃ

ওজোন সতরের ক্ষয় সমগ্র জীবজগত ও পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। যেমন-
(ক) মানুষে ত্বক ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা এবং চোখে ছানিপড়া রোগীর সংখ্যা ও অন্ধত্ব বেড়ে যাবে। এবং দেহের ইম্যুনতন্ত্র (immune system) দুর্বল হয়ে যাবে ফলে দেহে সহজেই জীবাণুর সংক্রমণ ঘটবে এবং অন্যান্য রোগ-ব্যাধি বেড়ে যাবে।
(খ) জীবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে, উদ্ভিদে ক্লোরোফিলের পরিমাণ হ্রাস পাবে, ফলে উৎপাদন কমে যাবে, মিউটেশনের হার বাড়বে, খাদ্যাভাবে মাছের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। এবং মাছ, পতজ্ঞা ও উভচরের ডিমে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার ফলে এদের বিলুপ্তি ত্বরান্বিত হবে।
(গ) বৃষ্টিপাত অনিয়ত হবে, বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাবে, ফাইটোপ্ল্যাংকটন ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খল বিপর্যস্ত হবে, ফলে এ শৃঙ্খলে অবস্থিত সকল প্রাণিগোষ্ঠীর বিলোপ ত্বরান্বিত হবে, এবং বিশ্বময় উষ্ণতায়নের গতি বেড়ে যাবে।

গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া

বায়ুমন্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারে অবস্থিত কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লুরোকার্বন গ্যাসমূহের মাত্রা বেড়ে গেলে সূর্যরশ্মি যখন ভূ-পৃষ্ঠে এসে তাপরূপে পুনর্বিকিরিত হতে পারে না, বরং উল্লিখিত গ্যাসগুলো তা শুষে নেয়, ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, তখন এ অবস্থাকে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া বলে। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য দায়ী যে কোনো গ্যাসকে গ্রীন হাউস গ্যাস বলে। যেমন-কার্বন ডাই- অক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরোকার্বনসমূহ, মিথেন, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ ছাড়াও আরও ৩৪ ধরনের গ্যাস। এসব গ্যাস উৎপন্ন হয় জীবাশ্ম জ্বালানী (কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস) দহন, বনভূমি ধ্বংস, গাছ-পালা পোড়ানো, জীবের শ্বসন ও পচন, চাষাবাদ, উচ্চ তাপের দহন ও ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি উৎস থেকে। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার একক প্রধান গ্যাস হিসেবে CO₂ কে চিহ্নিত করা হয়।

গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলাফল

গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশকেই কিছু না কিছু ফল ভোগ করতেই হবে। নিচে এ প্রক্রিয়ার কয়েকটি প্রধান ফলাফল উল্লেখ করা হলো।

(১) তাপমাত্রা পরিবর্তনঃ

গত ১০ হাজার বছরে পৃথিবীর যে তাপমাত্রা দেখা গেছে গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ায় তার গড় মাত্রা হবে আরও বেশী। ২১০০ সালের মধ্যে এ তাপ বৃদ্ধি হবে ১.৫-৪.৫°C। গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে সমগ্র বিশ্বে যে বর্ধিত তাপমাত্রা দেখা দেবে তাকে বিশ্বময় উষ্ণতায়ন (Global Warming) বলে।

(২) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ

গত ১০০ বছরে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১০-১৫ সেন্টিমিটার। মহাসাগরের প্রসারণ এবং হিমশৈলী ও বরফপিন্ডের গলনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে। ২১০০ সালের মধ্যে এ উচ্চতা আরও ১৫-৩০ সে.মি. বাড়বে, ফলে পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ ও উপকূলীয় দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ও জনগোষ্ঠী বিপত্তির সম্মুখীন হবে। ৫০ সে.মি. উচ্চতা বাড়লে পৃথিবীর ১০ কোটি মানুষ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়বে। উরুগুয়ের ৫০%, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের মাজুরো অ্যাটলের ৮০% এবং মালদ্বীপের পুরোটাই তলিয়ে যাবে।
[৫০ সে.মি. উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ সমুদ্র উপকূলের ৩ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা এবং নিম্নাঞ্চলের ১৫ ভাগ এলাকা প্লাবিত হবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের এক যষ্ঠমাংশ এলাকা এবং এক চতুর্থাংশ জনসংখ্যা দুর্দশাগ্রস্ত হবে। ফলে জাতীয় আয়ের ও কৃষি উৎপাদন ১৩% কমে যাবে। পৃথিবীর অনেক বন্দরনগরী (বুয়েনেস আয়ার্স, কলিকাতা, ইস্তাম্বুল, জাকার্তা, লন্ডন, লস এঞ্জেলস, ম্যানিলা, নিউইয়র্ক, রিও ডি জেনিরো এবং টোকিও)-ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাও রেহাই পাবে না।]

(৩) আবহাওয়াগত পরিবর্তনঃ

গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে ঋতুগত পরিবর্তন হবে। উঁচু অক্ষাংশে শীতকালের স্থায়িত্ব হবে কম, গ্রীষ্মকাল হবে দীর্ঘ, উষ্ণ ও শুষ্ক। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল আরও শুকনো হয়ে পরিত্যক্ত ভূমির সংখ্যা বাড়বে, ক্ষরা ও ধুলিঝড় হবে। মারাত্মক উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ ঘটবে। আর্দ্র অঞ্চলগুলোতে ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার প্রচন্ডতা বাড়বে।

(৪) কৃষি ব্যবস্থাপনাঃ

অনেক দেশে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। ভূনিম্নস্থ পানিস্তরে, নদী, খাড়ি ও কৃষি জমিতে নোনা পানির পরিমাণ বাড়বে, চাষাবাদ বিপর্যস্ত হবে। বিস্তীর্ণ চাষক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত বা বিলীন হয়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এভাবে হাতছাড়া হবে এক ষষ্ঠমাংশ কৃষি জমি।

(৫) বনভূমিঃ

পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলীয় বনভূমির অধিকাংশ বিলীন হবে, সে সংগে বিলীন হবে জীব বৈচিত্রের বিরাট অংশ। পৃথিবীর অনেক বনভূমি ও বন্যপ্রাণীই হুমকির সম্মুখীন হবে।

(৬) উপকূলঃ

অনেক উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র যেমন-নোনাপানির জলাশয়, ম্যানগুভ, জলা, প্রবাল প্রাচীর ও নদীজ বদ্বীপ বিপন্ন হয়ে পড়বে।

(৭) পেস্টঃ

তুষারাবৃত অনেক দেশের তুষার গলে যে চারণভূমি ও কৃষিজমি সৃষ্টি হবে তাতে একদিকে ফসলের বাম্পার উৎপাদন হবে, অন্যদিকে নতুন নতুন পেস্ট আবির্ভূত হয়ে ফসল ও বাস্তুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করবে।

(৮) হিমশৈলী ও তুষার বিগলনঃ

পরবর্তী ১০০ বছরে প্রায় এক তৃতীয়াংশ পার্বত্য বরফ বিগলিত হবে, ফলে ঋতুভিত্তিক নদীপ্রবাহ এবং কৃষি পানি-বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে।

(৯) মানুষের রোগ-ব্যাধিঃ]

তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত ও উষ্ণ বায়ুপ্রবাহে অনেক প্রাণহানী ঘটবে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গী, ইয়েলো ফিভার ও এনসেফালিটিস-এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটবে। তা ছাড়া, বিকিরণজনিত রোগ-ব্যাধিরও প্রকোপ বাড়বে।

উল্লেখিত ফলাফলের কথা চিন্তা করেই সারা পৃথিবীকে সতর্ক করার উদ্দেশ্য জাতিসংঘের UNEP (United Nations Environment Programme) ১৯৮৯ সালে যে স্লোগান নির্বাচন করেছিল আজ এবং ভবিষ্যতেও তা সমান প্রযোজ্য হবে। ১৯৮৯ সালের ৫ই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস-এর সেই স্লোগান ছিল “Global Warming: Global Warning”।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনি কি সম্মত?
প্রিয় ব্যবহারকারী, আপনারা এই ওয়েব সাইটের সকল নিয়ম, নীতিমালা এবং শর্তাবলী পড়ে এবং মেনে এই ওয়েব সাইট ব্যবহার করতে একমত কি?
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.